ঢাকা শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ৩০ কার্তিক ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আতিথেয়তার সৌন্দর্য ও গুরুত্ব

আতিথেয়তার সৌন্দর্য ও গুরুত্ব

পরিচিত-অপরিচিত যে কোনো মেহমানের মেজবানি করা সব নবী-রাসুলের সুন্নত, সাহাবায়ে কেরামের গুণ এবং ইসলামের তাগিদপূর্ণ নির্দেশ। আতিথ্য দ্বারা কার্পণ্য দূর হয়, মহব্বত সৃষ্টি হয়, সুসম্পর্ক তৈরি হয় এবং আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়, সুসংহত হয়।

ইবরাহিম (আ.)-এর মেহমানদারি : ইবরাহিম (আ.)-এর অকৃপণ মেহমানদারি সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘(হে রাসুল!) আপনার কাছে কি ইবরাহিমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে? যখন তারা ইবরাহিমের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, সালাম। তখন ইবরাহিমও বলল, সালাম, (আর সে মনে মনে ভাবল,) এরা তো অপরিচিত লোক। তারপর সে চুপিসারে নিজ পরিবারের কাছে গেল এবং একটি মোটাতাজা বাছুর নিয়ে এলো। এরপর তা সেই অতিথিদের সামনে এগিয়ে দিল। বলল, আপনারা খাচ্ছেন না যে? (সুরা জারিয়াত : ২৪-২৭)। তাফসিরে কাশশাফে এসেছে, ইবরাহিম (আ.) মেহমান ছাড়া আহার গ্রহণ করতেন না। (২/৬৪৩)। মুনাবি (রহ.) বলেন, ‘ইবরাহিম (আ.)-কে আবুয যয়ফান বা মেহমানদের বাবা বলা হতো। কখনও কখনও মেহমানের তালাশে এক দুই মাইল পর্যন্ত হাঁটতে থাকতেন তিনি।’ (তাফসিরে সামআনি : ৫/২৫৭)।

রাসুল (সা.)-এর মেহমানদারি : আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর মেহমানদারি ছিল প্রবাদতুল্য। মেহমান এলে তার আদর-আপ্যায়ন ও খাতির-তাওয়াযুতে সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করতেন। অল্পবেশি যা থাকত, প্রশস্ত হৃদয়ে পেশ করতেন। মেহমানের মেহমানদারীতে এতটুকু কৃপণতা বা সংকীর্ণতা করতেন না। এমনকি আগন্তুক মেহমান অমুসলিম হলেও এর ব্যত্যয় ঘটত না। এ জন্যই তো প্রিয়নবী (সা.) প্রথম অহি লাভ করার পর যখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘরে ফেরেন, তখন প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী খাদিজা (রা.) চরিত্রের মহোত্তম রূপ তুলে ধরে তাকে সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে দেন এভাবে, ‘কিছুতেই নয়, আল্লাহ কখনও আপনাকে অপদস্থ করতে পারেন না। কেননা, আপনি আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখেন, অন্যের বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব ব্যক্তির উপার্জনের ব্যবস্থা করেন, মেহমানের সামনে খাবার পেশ করেন এবং সত্যের পথে আসা বিপদণ্ডদুর্যোগে সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করেন।’ (বোখারি : ৩)।

সাহাবির মেহমানদারি : প্রিয়নবী (সা.)-এর দরবারে এক লোক এলো। মেহমানদারির চিরাচরিত অভ্যাস অনুসারে নবীজি (সা.) ঘরে সংবাদ পাঠালেন। স্ত্রীরা উত্তর পাঠালেন, ‘ঘরে পানি ছাড়া কিছুই নেই।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘কে এই লোকের মেহমানদারি করতে প্রস্তুত?’ এক আনসারি সাহাবি দাঁড়িয়ে গেলেন। স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি প্রস্তুত।’ সেই লোককে নিয়ে তিনি বাড়ি পৌঁছলেন।

ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে বললেন, ‘আল্লাহর নবীর মেহমানকে সম্মান করো।’ স্ত্রী বললেন, ‘আমাদের কাছে তো বাচ্চাদের খাবার ছাড়া কিছুই নেই।’ সাহাবি বললেন, ‘যা আছে, তা-ই প্রস্তুত কর।’ নির্দেশ মোতাবেক স্ত্রী বাতি জ্বালালেন। বাচ্চাদের অভুক্ত রেখেই ঘুম পাড়ালেন। তারপর যৎসামান্য যা ছিল, মেহমানের সামনে পেশ করা হলো। একটুপর বাতি ঠিক করার অজুহাতে এসে বাতি নিভিয়ে দিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আওয়াজ করে মুখ নাড়াতে লাগলেন। যেন মেহমানের সঙ্গে তারাও খাচ্ছেন। এভাবে মেহমানকে খাইয়ে নিজেরা অনাহারেই রাত পার করলেন। সকালে রাসুল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হলে বললেন, আজ রাতে তোমরা তোমাদের মেহমানের সঙ্গে যে অপূর্ব আচরণ করেছ, তাতে আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর কোরআনে কারিমের এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, ‘ক্ষুধার্ত থাকার পরও তারা নিজেদের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দেয়। বস্তুত যাদেরকে মনের কৃপণতা থেকে মুক্ত করা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর : ৯, বোখারি : ৩৭৯৮)।

মেহমানদারি ঈমানী দায়িত্ব : বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত কোনো মেহমান এলে খুশি হওয়া এবং পুণ্য লাভের অপূর্ব সুযোগ মনে করে তা লুফে নেওয়া মানবিক কর্তব্য; ঈমানী দায়িত্বও বটে। মেহমান আসার কথা শুনে ভ্রূকুটি করা কিংবা মনঃক্ষুণ্ন হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তিমাত্রই যেন আপন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। সে যেন মেহমানকে সম্মান করে, তাদের সঙ্গে ভালো কথা বলে কিংবা নীরব থাকে।’ (বোখারি : ৬০১৮)।

আত্মীয়তা রক্ষার মাধ্যম : যত্নআত্মি ও মেহমানদারি আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রাখার অন্যতম মাধ্যম; যা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক আরশ ধরে বলতে থাকবে, যে আমার সম্পর্ক বজায় রেখেছে, আল্লাহ যেন তার সম্পর্ক বজায় রাখেন; আর যে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আল্লাহ যেন তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (মুসলিম : ২৫৫৫)।

মেহমানদারির প্রতিদান : একবার নবীজি (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে এমন কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আলোকভেদ্য বালাখানা রয়েছে, যার ভেতর-বাহির সম্পূর্ণ পরিদৃষ্ট হবে।’ এক বেদুইন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এগুলোর হকদার হবে কারা?’ উত্তর দিলেন, ‘যারা নম্র ভাষায় কথা বলে, খাবার দান করে, বেশি বেশি রোজা রাখে এবং রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সালাত আদায় করে।’ (তিরমিজি : ১৯৮৪)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা করুণাময়ের ইবাদত কর, খাবার দান কর, সালামের প্রসার কর, বিনিময়ে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (তিরমিজি : ১৮৫৫)।

আতিথেয়তা,ইসলাম
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত