সবার শুভবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যাঁরা আমার লেখা পড়ছেন বা পড়বেন। আমি সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ইসলাম একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী ধর্ম বলেই আমি এ ধর্মের অনুসারী এবং বিশ্বাসী। তবে এ ধর্মের লৌকিক ধর্মাচারে আমি অত্যন্ত দুর্বল।
এক মাওলানাকে বলতে শুনেছি, যারা মসজিদে জামাতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে না, তারা মুসলমানের কাতার থেকে খারিজ হয়ে যাবে! মাওলানার মতে ওইসব ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাদের জানাজা পড়াও নাকি নাযায়েজ! মাওলানার বক্তব্য যদি সত্যি হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত জাহান্নামি। তবে আমি তা বিশ্বাস করি না- কারণ আমি জানি, আল্লাহ শুধুমাত্র মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যেই বান্দার পাপ-পূণ্যের বাটখারা নির্ধারণ করেনি। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা উত্তম আমলের কাজ। আমার জানামতে ধর্ম পালন প্রতিপালন এতো ছোট কিছু নই। মহাজাগতে ধর্ম পালন প্রতিপালনের হাজারো দিক রয়েছে। আমিও সহজ এবং কঠিন পথে তা পালনের চেষ্টা করি।
এবার আসি অনাচার প্রসঙ্গে। পৃথিবীর কোনো ধর্মই অনাচারকে সমর্থন দেয় না। মধ্যপ্রাচ্যে যখন একটি মুসলিম দেশ আরেকটি মুসলিম দেশের ওপর জুলুম, নির্যাতন করছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, তখন মানবিক কাতরতায় বিবেক রুদ্ধ হয়ে পরি, অফিসের ডেস্কে বসে সেসব সংবাদ সম্পাদনা করি। তখন চোখ ভিজে যায় আবেগের জলে। মনের আকুলতায় সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করি নির্যাতিত মানুষদের প্রতি সদয় হবার জন্যে।
ইতিহাসের কলঙ্ক শতাব্দীর ভয়াবহতম রোহিঙ্গা নির্যাতনে বুক ভেঙেছে বার বার। আবেগের জলে কলম ডুবে গেছে নিজের অজান্তে তবু লিখে গেছি সাধ্যমতো। দিল্লি কলকাতা আসামে মুসলমান নির্যাতনের খবরেও আমার ভাঙা বুকটা একইভাবে ফুঁফিয়ে উঠেছে বার বার। সাম্প্রতিক ঘটনাতেও কাঁদছি।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ, রক্তাক্ত, বিভৎস্য লাশের স্তুপ আর বারুদের গন্ধে বেড়ে ওঠা এক ক্ষুদে সংবাদকর্মী আমি।
দীর্ঘসময়ের পেশাগত অভিজ্ঞতায় জেনেছি সামপ্রদায়িকতা একটা পরিবার, একটা সমাজ বা রাষ্ট্রকে কতটা পেছনে টেনে নিতে পারে। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি থাকে না, সেই সমাজ বা রাষ্ট্রকে অমানবিক রাষ্ট্রের কাতারে গন্য করা হয়। যে সমাজে সাম্প্রদায়িক বর্বতা চলে, সে সমাজের মানুষকে সভ্যরা পশুতুল্য বিবেচনা করে। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমার এমন শুভবোধ হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হবার কারণে। দুর্ভাগ্য আমাদের এমন অসহনীয় বিষময় অভিশাপ থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি।
রাজনৈতিক কুচক্রীরা বার বার ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে।
আমি বিস্মিত হই- সাম্প্রদায়িকতার আগুনমাখা বাতাসের নিশ্বাস নিয়েও সরকারের এক মন্ত্রী মহোদয় বলছেন- বাংলাদেশ নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তিনি কোন বিবেচনায় বাংলাদেশকে সম্প্রীতির মডেল বলছেন! গত এক দশকের ঘটনা কি তাই বলে?
২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় ১৭টি বৌদ্ধ মন্দির, ২টি হিন্দু মন্দিরসহ অর্ধশতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও সম্পদ লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
২০১৩ সালে ফটিকছড়িতে, ২০১৪ সালে হবিগঞ্জের মাধবপুরে, এরপর ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলাতেও হিন্দুদের ১৭টি মন্দির এবং শতাধিক বাড়ি ধ্বংস ও সম্পদ লুটপাট করা হয়।
২০১৭ সালেও রংপুরের গঙ্গাছড়াতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। একই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লাতেও সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। আর সবশেষে অতিসম্প্রতি শারদীয় উৎসব ঘিরে কুমিল্লার নানুয়ারদীঘি থেকে পীরগাছার রামনাথপুর পর্যন্ত যা ঘটেছে তা তো দেশবাসীর চোখে এখনো জ্বল জ্বল করছে।
এসব ঘটনায় মামলা হয়, গ্রেফতার হয়, আসামীরা ছাড়াও পেয়ে যায়। একের পর এক তদন্ত চলতেই থাকে। পাল্টাপাল্টি রিট হয়। দীর্ঘ সময়েও বিচার কার্য সম্পন্ন হয় না। একসময় বাদী বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতায় আশাহত হয়ে আগ্রহ হারিয়ে আদালতে গরহাজির থাকেন। যারফলে বিচারের মোড় ঘুরে যায়। এভাবেই চলছে এসব ঘটনার বিচার কার্য। রামু থেকে রামনাথপুর- বিচার কাজে কি নতুন কিছু আশা করা যায়? এমন প্রশ্ন অনেকের মুখে মুখে। তবে আমি আশাবাদী মাননীয় আইনমন্ত্রী সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে এসব সাম্প্রদায়ীক হামলার বিচার হবে।
এবারের শারদীয় উৎসবে সহিংস ঘটনায় বাংলাদেশ কতটা পিছিয়েছে তা দেশের সচেতন মানুষরাই অনুমান করতে পারছেন। এবার আসি ‘আমরা কেন এমন হলাম’ এই আলোচনায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি অনুসন্ধানী মনোভাবের ছিলাম। পেশাগত জীবনটাও অনুসন্ধান আর নিবিড় ভাবনার মধ্যেই বয়ে চলেছে। আমার উপলব্ধি আর গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই মতামত উপস্থাপন করছি। এটি আপনার মতের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। সেজন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
প্রায় দুই দশক আগে থেকেই আমরা এ দেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অতিমাত্রায় তাচ্ছিল্য করা শুরু করেছি, (সবাই নয়)। এর কারণ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মাঝেও ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি এক বিদ্বেষভাবাপন্ন মনোভাব গড়ে উঠেছে (কথাটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)।
এর মূল কারণ শিক্ষায় গলদ। কোমলমতি শিশু কিশোরদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নাস্তিক, মুরতাদ, কেউ কেউ আবার কাফির মোনাফেকও। যদিও প্রকৃত ইসলাম ধর্মে আছে এর উল্টোটা। এসব ভুল শিক্ষা সব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই।
অধিকাংশই অজপাড়া গায়ের স্বল্প শিক্ষিত ধর্মীয় শিক্ষকরাই না জেনে ছাত্র-ছাত্রীদের এমন কুশিক্ষা দিয়ে থাকেন। আবার ওই শ্রেণির মানুষের পারিবারিক বা সামাজিক পরিমন্ডলেও এসব অপসংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে। যারফলে দূর থেকে বা কাছে থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুটাকেও বলতে শোনা যায়- ‘শালা ডান্ডির বাচ্চা আসতে দেরি করলি কেন?’ ( ডান্ডি, ডেডা, মালাউন, মালু এসব শব্দ আমাদের দেশে ঘৃণা বা গালি শব্দে চরম তাচ্ছিল্য করে হিন্দুদের বোঝায়) ‘দেখ মালাউনের বাচ্চা করছেটা কি?’।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডান্ডি, ডেডাইয়া বা ডেডা শব্দটি হিন্দুদের বুঝাতে অধিক ব্যবহার হয়। ‘ডেডা’ বা ‘ডেডাইয়া’ শব্দের কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুমাণ করছি চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডেডা বা ডেডাইয়া শব্দটি হয়তো ডান্ডি শব্দের অপভ্রংশ। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলাকে বলা হয় প্রাচ্যের ডান্ডি। ইংরেজী ভাষায় এই শব্দটির অর্থ ফ্যাশন সচেতন বা স্টাইলিস। আবার দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মালাউন বা মালু বলতে হিন্দুদের বোঝানো হয়। ‘মালাউন’ আরবী শব্দ। এটি একটি গালি। এর অর্থ অভিশপ্ত বা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত।
এটি হিন্দুদের গা সওয়া বিষয়। এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এতটুকুন তাচ্ছিল্য সইতে হবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে অধিক প্রচলিত হওয়ায় প্রসঙ্গক্রমে হিন্দুরাও এই শব্দটি এখন ব্যবহার করে থাকেন। যেমন- ‘আঁরা ডেডার পোয়া’, অর্থাৎ আমরা হিন্দুর সন্তান। আলোচ্য এ বিষয়টি এই বাংলাদেশের জন্য অতি ক্ষুদ্র ও নগন্য বিষয়ই বলা যায়।
এ বিষয়ে ইসলাম কি বলছে কোরআনের সূরা আল হুজরাতের ১১ নম্বর আয়াতে আছে “হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম, আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রুপ করো না। এবং পরষ্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর গোনাহর কাজে প্রসিদ্ধ লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম।” সূত্র- ইসলামের বাণী ডট নেট।
ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশিকে মুখে মুখে বা মনে মনে এমন শব্দটি ব্যবহারের আগে ভাবুন। কারণ আপনার প্রিয় ইসলাম ধর্ম এটিকে গোনাহের কাজ বলেই মনে করে।
এছাড়াও আমরা যখন উন্নয়নশীল দেশের সভ্য নাগরিক হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি তখন ক্ষুদ্র এ বিষয়টি আমাদের কতটুকু মানসিকতার পরিচয় বহন করাচ্ছে তা কি একবারও ভেবে দেখেছি?
অবহেলায় জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢুকে গেছে অধর্মের অনাচার।
আমরা সুদ, মুনাফা, লাভ আর লোভের ফাঁদেও ধর্মকে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে চলেছি। যেমন- ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী হাসপাতাল, ইসলামীয়া হোটেল, ইসলাম পরিবহন। এছাড়া বিখ্যাত অলি আউলিয়াদের নাম বিকাতেও পিছপা হইনি। যেমন বারো আউলিয়ার চট্টগ্রামে হোটেল রেস্টুরেন্ট, বাস, মিনিবাস, টেম্পু রিকসাসহ সর্বত্র এসব নামের ছড়াছড়ি। অধিকাংশ ধর্মান্ধরাই মঙ্গলার্থে এসব নামকরণ করেন। তবে এসব পবিত্র নামের প্রতি কতটুক সুবিচার বা সম্মান করা হয় তার বাস্তব উপলব্দি করার সংখ্যা আমাদের মধ্যে খুবই নগন্য। এসব প্রতিষ্ঠানে কতটুকু ইসলামী রীতি রেওয়াজ অনুসরণ করা হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেবার নামে একদিক ছাড় দিলে অন্যদিকে গলা কেটে রাখার মতো অবস্থা।
দেশে মাদ্রাসা শিক্ষিত লক্ষ লক্ষ যুবক বেকার, কর্মসংস্থান নেই। যারফলে এলাকাভিত্তিক নামসর্বস্বভাবে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গড়ে উঠছে মাদ্রাসা। আবার মক্তব টার্গেট করেও কোনো কোনো এলাকায় গড়ে উঠে আল্লাহর ঘর মসজিদ। এসব মসজিদে প্রায়ই পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। অধিকাংশের ক্ষেত্রে সমাজের দুর্নীতিবাজরাই এসব মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা বা পরিচালক হয়ে থাকেন। এদের অর্থের যোগান আর চাঁদায় চলে এসব মসজিদ। নগরীতে দেখা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বা শিক্ষকরা হাতে রশিদ বই নিয়ে পরিবহনে উঠে মসজিদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছে। আবার ব্যস্ত সড়কে বসে মাইক লাগিয়েও একই কাজ করছেন।
কালেকশনের এসব অর্থ একভাগ আদায়কারীর, একভাগ প্রতিষ্ঠানের এবং একভাগ ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির। আমি জানি না ইসলাম ধর্ম এসবকে কতটুকু সমর্থন করে। তবে আমার কাছে মনে হয়, এসব করে ধর্মকে ছোট করা হচ্ছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে ধর্মকে যেখানে সেখানে ব্যবহারের এমন নজির আছে বলে মনে হয় না।
ধর্ম পালনের চেয়ে ধর্মের নাম ব্যবহারে আমরা যে বেশি পটিয়সী তারই সুযোগ নিচ্ছেন রাজনৈতিক চক্রান্তকারীরা। আমরা যেন ধর্মের নামে চিরায়ত এক খোলসে আবদ্ধ হয়ে গেছি। এ থেকে আমাদের মুক্ত হতেই হবে। আসুন আমরা সচেতন হই।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ ofshamimbd@gmail.com