ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঘাতক তামাক রুখতে কার্যকর হোক স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশিকা

ঘাতক তামাক রুখতে কার্যকর হোক স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশিকা

তামাকের ব্যবহার সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ, যা প্রতিরোধযোগ্য। এর ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অসুস্থতা, অক্ষমতা, পঙ্গুত্ব, মৃত্যুহার বৃদ্ধিসহ আর্থিক ব্যয় ও পরিবেশগত বিপর্যয়। দেশে ধূমপানের পাশাপাশি পানের সাথে জর্দা, সাদা পাতা খাওয়া সমাজে প্রচলিত আছে। বিড়ি-সিগারেট, জর্দা ও সাদা পাতা বা অন্যান্য তামাকপণ্য সেবন মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশটি তামাক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে একটি বলে বিবেচিত। এ মুহুর্তে অর্থনীতির চেয়ে মানুষের জীবনকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশের বিশ্ব নেতারা জনস্বাস্থ্যকে বেশি গুরুত্ব¡ দিচ্ছেন। অর্থনীতির বিবেচনায় যাই হোক, এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাই মহামারির এই পরিস্থিতিতে তামাক কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে সরকার দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

অপরপক্ষে তামাক কোম্পানিগুলোর মুল টার্গেট শিশু, কিশোর ও তরুণ সমাজ। তামাক ও ধূমপানে আসক্ত করার পাশপাশি তামাক কোম্পানিগুলো ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। টোব্যাকো এটলাস-২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে ১ লাখ ৬০ হাজার ২০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের এক জরিপের দেখা যায়, শতকরা ৯০.৬ ভাগ স্কুল ও খেলার মাঠের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। আবার শতকরা ৬৪.১৯ ভাগ দোকানে ক্যান্ডি, চকলেট এবং খেলনার পাশে তামাকজাত দ্রব্য রেখে বিক্রি করতে দেখা যায়। শতকরা ৮২.১৭ ভাগ দোকানে তামাকের বিজ্ঞাপন এবং শিশুদের দৃষ্টি সীমানার মধ্যে শতকরা ৮১.৮৭ ভাগ দোকানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন হয় বলে ঐ জরিপে উঠে আসে। তামাক কোম্পানিগুলো কুটকৌশলে তামাকপণ্য শিশু ও যুবকদের সামনে তুলে ধরে। এর মূল কারণ তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটানো।

সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের স্বার্থে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনস্থ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান একটি সুপরিকল্পিত কর্ম পরিকল্পনা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ এ নির্দেশিকার আলোকে সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ নির্দেশিকা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি হতে রক্ষা করবে। এই নির্দেশিকাটি স্থানীয় সরকার বিভাগের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আওতাভূক্ত সকল পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের মাত্রা হ্রাস করে জনসাধারণকে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির প্রভাব থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও প্রদান করবে।

এছাড়া এই নির্দেশিকা তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় ও বিপণন নিয়ন্ত্রণের জন্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্তদের নির্ধারিত ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ব্যবস্থা করেছে। এর কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশের এলাকা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতার কারণে বাড়ছে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা। স্থানীয় সরকার বিভাগের এই উদ্যোগ প্রসংশিত এবং যুগান্তকারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

যখন স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশিকাটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখনই তামাক কোম্পানীর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকারের এই অর্জনকে ম্লান করে দেয়ার জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠেছে। তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮(১) এবং স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ তফসিল ১ ও ৫ অনুসারে স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা উপেক্ষা করে তামাক কোম্পানীগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত পণ্য বিক্রি করছে। বিধায় এই নির্দেশিকা জনগণের রক্ষাকবজ হলেও তা তামাক কোম্পানির মৃত্যু পণ্য বিপণন ও মুনাফার পথে অন্তরায়।

ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ও নিবন্ধন ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন এলাকায় যত্রতত্র তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত হবে, ফলে আগামী প্রজন্ম ঘাতক তামাকের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যখন দেশের মানুষ ঘাতক তামাক নিয়ন্ত্রণে আশার আলো দেখছে, তখনই নির্দেশিকাটি বাতিলে তামাক কোম্পানীগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং নীতিনির্ধারকদের বিভিন্নভাবে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

মিডিয়া ও বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি স্থানীয় সরকার বিভাগ আগামী ১৫ নভেম্বর তামাক কোম্পানীর প্রতিনিধি ও তামাক ব্যবসায় সংশ্লিষ্টদের সাথে সভা করা ও নির্দেশিকা নিয়ে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যা অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও জনস্বার্থের পরিপন্থি। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা আছে। বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করেছে, তাই এফসিটিসি ও এর আর্টিকেল ৫.৩ ও অন্যান্য আর্টিকেলসমূহ প্রতিপালন করা সরকারের দায়িত্ব। এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩- তে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সব ধরনের তামাকপণ্য থেকে যুব সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা হবে’ এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিশীল থাকা।

লেখক: ইকবাল মাসুদ, পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এবং সদস্য, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

ঘাতক তামাক,ইকবাল মাসুদ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত