ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজা নিয়ে বিশ্বমোড়লদের অবস্থানে অস্পষ্টতা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
গাজা নিয়ে বিশ্বমোড়লদের অবস্থানে অস্পষ্টতা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা মেনে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে হামাস। তবে কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে চায় তারা। ট্রাম্প হামাসের বিবৃতিকে ইতিবাচকভাবে নিলেও তাদের আলোচনার দাবি নিয়ে এখনও কিছু বলেননি। এদিকে ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী গাজায় সামরিক অভিযান সীমিত করা হবে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল, তবে হামলা পুরোপুরি বন্ধ হবে কিনা, এ রকম কিছু বলেনি তারা। ট্রাম্প ইসরায়েলকে গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানানোর পরও গাজায় বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ দেখা গেছে। অন্তত তিনটি জায়গায় ইসরায়েলি হামলা হয়েছে বলে স্থানীয় হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বোমা হামলার কারণে উপত্যকার হাসপাতালগুলোতে ৬৬ জনের মৃতদেহ এবং ২৬৫ জনকে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীরা পৌঁছাতে না পারায় এখনও অনেক ভুক্তভোগী ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে আছে। মন্ত্রণালয় অনাহার এবং অপুষ্টির কারণে দুই শিশুর মৃত্যুর তথ্যও রেকর্ড করেছে। ফলে অপুষ্টিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা পুরোপুরি বন্ধ হবে কিনা এবং সেখানে শান্তি ফিরবে কি না, এ নিয়ে এখনও রয়ে গেছে অনেক প্রশ্ন।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা : কিছুদিন আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হোয়াইট হাউস সফরের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রস্তাব হলো- গাজায় সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। হামাসের হাতে আটক ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি এবং দু’ডজনেরও বেশি মৃতদেহের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। শত শত আটক ফিলিস্তিনিকে এবং গাজার অন্যান্য বাসিন্দাদের দেহাবশেষ মুক্ত করবে ইসরায়েল। হামাস তাদের অস্ত্র সমর্পণ করবে এবং গাজা শাসনে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। পক্ষগুলো এসব প্রস্তাবে সম্মত হলে পূর্ণ সহায়তা অবিলম্বে গাজা উপত্যকায় পাঠানো হবে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারসহ অন্যান্য নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি আন্তর্জাতিক বোর্ড অব পিস বা শান্তি বোর্ড গঠন করা হবে। এর তত্ত্বাবধানে একটি টেকনোক্র্যাটিক, অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটির মাধ্যমে গাজা উপত্যকার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা হবে। এ পরিকল্পনাটি ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য দরজা উন্মুক্ত রেখেছে। যদিও নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে এ প্রস্তাবটি বাতিল করেছেন।

হামাসের মত-দ্বিমত : গাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে, সেখানে ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনায় পুরোপুরি সম্মতি জানানো হয়নি। তবে যুদ্ধ শেষ করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও আরব নেতারা যেসব বিষয়কে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছিলেন, সেগুলো মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছে তারা। যেসব বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন- হামাস তাদের হাতে বন্দি থাকা সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য যে সময়সীমা দিয়েছেন, তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই তারা এ তথ্য জানান। একই সঙ্গে হামাস এটাও বলেছে, তারা ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐকমত্য এবং আরব ও ইসলামি নেতাদের সমর্থনের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত স্বাধীন ফিলিস্তিনি সংস্থার (যা টেকনোক্র্যাটদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে) কাছে গাজা উপত্যকার প্রশাসন হস্তান্তর করতেও রাজি আছে।

যেসব বিষয়ে হামাস আলোচনা চায় : গোষ্ঠীটি তাদের বিবৃতিতে নিরস্ত্রীকরণের কথা উল্লেখ করেনি। গাজার শাসনব্যবস্থায় ভবিষ্যতে আর কোনো ভূমিকা পালন করবে না, এ রকম কিছুও তারা বলেনি। তবে ট্রাম্প এ বিষয়গুলোতে রাজি হবেন কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এদিকে ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবরের হামলায় অংশগ্রহণকারী হামাসের মিত্র ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রতি হামাসের প্রতিক্রিয়াকে সমর্থন করেছে। প্রায় দু’বছর আগের ওই হামলার সময় ইসরায়েল থেকে ধরে নেওয়া ২৫১ জনের মধ্যে হামাসের হাতে এখনও ৪৮ জন জিম্মি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে মাত্র ২০ জন জীবিত বলেও মনে করা হচ্ছে।

এ ছাড়া ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ বন্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং হামাসের বক্তব্যকে ইতিবাচক বলে বর্ণনা করেছেন।

ইসরায়েল যা যা করছে : ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম বলছে, শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে এগিয়ে নিতে আলোচনাকারী দলগুলোকে আলোচনা শুরু করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। চ্যানেল টুয়েলভণ্ডএর প্রতিবেদন অনুসারে, তাদের আলোচনার জন্য আজই চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও আলোচকরা কোথায় ভ্রমণ করবেন, তা স্পষ্ট নয়। এর আগে হামাস বিবৃতি দেওয়ার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অবিলম্বে বাস্তবায়নে ইসরায়েল প্রস্তুত হচ্ছে। এ ছাড়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানায়, আইডিএফ প্রধান সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাতভর বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়ন নিয়ে আগেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। বিবৃতিতে গাজায় সামরিক তৎপরতা হ্রাস করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে জানানো হয়েছে, সেনারা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে। যাতে যে যেকোনো মুহূর্তে হুমকির জবাব দিতে পারে।

অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা : কিছুদিন আগে হোয়াইট হাউস একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে। যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা এগিয়ে গেলে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিভিন্ন রেখা দেখানো হয়েছে। যদিও মানচিত্রটি কিছুটা আনুমানিক বলে মনে হচ্ছে। যদি শান্তি পরিকল্পনা হোয়াইট হাউসের মানচিত্রে দেখানো সীমানা অনুসরণ করে, তাহলে সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক প্রত্যাহারের পরও গাজার প্রায় ৫৫ শতাংশ ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে থাকবে। দ্বিতীয় প্রত্যাহারের পর গাজার প্রায় ৪০ শতাংশ দখল ইসরায়েলের হাতে থাকবে। আর প্রত্যাহারের চূড়ান্ত পর্যায়ে, যা একটি নিরাপত্তা বাফার জোন তৈরি করবে। এরপরও গাজার প্রায় ১৫ শতাংশ দখল করে রাখবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) নিজস্ব মানচিত্রের সর্বশেষ সংস্করণে তারা বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র বলে যে এলাকা দেখিয়েছে, তা গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এদিকে শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে হামাসের জবাবে যদিও কিছুটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তবে পরিকল্পনার মূল কয়েকটি বিষয় নিয়ে হামাস তাদের অবস্থান না জানানোর কারণে সংঘাতে এরপর কী হতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত নয়। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিরসনে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা অলিভার ম্যাকটার্নান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হামাস এখন ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে, তারা শান্তি পরিকল্পনার কিছু দিক নিয়ে আরও আলোচনার জন্য হামাসের আহ্বান মেনে নেবে কি না। সহিংসতার জন্য কোন পক্ষকে দায়ী করা হচ্ছে, তার দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ।’

বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া : ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার কিছু অংশ হামাস গ্রহণ করার বিষয়টি বিশ্বনেতারা ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা অন্যান্য যেসব বিষয়ে সম্মতি আসেনি, সেগুলো নিয়ে আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘গাজার মর্মান্তিক সংঘাতের অবসান ঘটানোর সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমি সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি।’ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও আলোচনা এবং টেকসই শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য যুক্তরাজ্যের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘শান্তি পরিকল্পনার অন্তত কিছু অংশ হামাস গ্রহণ করায় যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা এবং যাদের অত্যন্ত প্রয়োজন, তাদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা সব পক্ষকে বিলম্ব না করে চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছি।’

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান বলেছেন, ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার প্রতি হামাসের প্রতিক্রিয়া স্থায়ী শান্তি অর্জনের দিকে একটি গঠনমূলক এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।’ জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎস বলেছেন, ‘জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজার শান্তি এখন নাগালের মধ্যে। প্রায় দুই বছর পর এটি শান্তির সেরা সুযোগ।’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘গাজায় সব জিম্মির মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি নাগালের মধ্যে! দেরি না করে হামাসের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করা উচিত।’ ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, ‘সবার জন্য এখন অগ্রাধিকার হওয়া উচিত এমন একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো, যা সব জিম্মিকে অবিলম্বে মুক্তির দিকে পরিচালিত করে। ইতালি তার ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত।’

লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত