ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পাক-আফগান হামলার নেপথ্য রহস্য

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
পাক-আফগান হামলার নেপথ্য রহস্য

২০ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক কাবুলের ৪৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনঃনিয়ন্ত্রণের ঘোষণার ২০ দিন পর আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারত সফরকালে ১০ সেপ্টেম্বর কাবুলে পাকিস্তান ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান তেহরিক-ই-তালেবানের (টিটিপি) প্রধান নেতা নুর ওয়ালি মাসুদকে লক্ষ্য করে ইসলামাবাদ এ হামলাটি চালায়। তার প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তে পাকবাহিনী ও একাধিক পাক সীমান্ত চৌকির ওপর তালেবান বাহিনী ব্যাপক হামলা চালায়। হামলা-পাল্টা হামলায় উভয় পক্ষের হতাহতের ঘটনা ঘটে। সীমান্ত এলাকায় বর্তমানে উভয় দেশ ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের এ সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত বদলের আরেকটি উদাহরণ মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকমহল।

মিত্র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের কারণ : আফগানিস্তানে প্রথম তালেবান সরকারকে (১৯৯৬-২০০১) স্বীকৃতি দেওয়া মাত্র তিনটি দেশের একটি ছিল পাকিস্তান। কিন্তু ২০২১ সালে বর্তমান তালেবান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বেশ তিক্ত। ২০০১ সালে তালেবান বাহিনীকে হটিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘ ১৯ বছর আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে যে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল, তার অন্যতম সহযোগীর ভূমিকায় ছিল পাকিস্তানের সেনাসমর্থিত সরকারগুলো। ফলে বর্তমান তালেবান সরকারের নেতৃবৃন্দকে শুরু থেকেই পাকিস্তানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। ইসলামাবাদের অভিযোগ, তালেবান প্রশাসন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) যোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। তবে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে কাবুল। টিটিপির লড়াইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে পাকিস্তানি সরকারব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সেখানে নিজেদের মতো শরিয়া শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। আফগান তালেবান এবং পাকিস্তানি তালেবান একই মতাদর্শ এবং প্রভাবশালী পশতুন জাতি থেকে উঠে আসা।

পাক-আফগান বিরোধের ইতিবৃত্ত : অষ্টাদশ দশকের শেষের দিকে রাশিয়া জার বাহিনী একের পর এক মধ্য এশীয় অঞ্চল দখল করতে করতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পামির সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত চলে আসে। তখন ব্রিটিশ ভারত মধ্য এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। কিন্তু আফগানিস্তানকে কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। ব্রিটিশরা তখন আফগানিস্তান দখলে নিতে কয়েকবার আক্রমণ চালায়। ১৮৮০ সালের দিকে দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের পরে আফগানিস্তানের তখনকার আমির ব্রিটিশের হাতে একরকম আটকা পড়ে যান। তখন আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশের অধীনে এবং অভ্যন্তরীণ কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন একটা দেশে পরিণত হয়। কৌশলগত খাইবার পাসের নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষায় তখন ব্রিটিশ ভারত তাদেরই অধীনস্থ আফগান আমির আবদুর রহমান খানকে একটা সীমান্ত চুক্তি করতে বাধ্য করে। এর পরপরই ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার মার্টিমার ডুরান্ড এ সীমানা নির্ধারণী রেখাটি আঁকেন বলে এর নামকরণ হয় ‘ডুরান্ড লাইন’।

১৮৯৩ সালে স্বাক্ষরিত সেই ডুরান্ড লাইন চুক্তির কারণে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় পাখতুন বা পশতুন ও বেলুচিস্তানের প্রায় অর্ধেকটারও বেশি ব্রিটিশ ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন আফগান আমির আবদুর রহমান। এতে পশতুন উপজাতিদের একটা বড় অংশ ব্রিটিশ ভারতের অংশ হয়ে যায়; বাকিটুকু আফগানিস্তানের অংশ হিসেবে থেকে যায়। অর্থাৎ পশতুন বা পাঠান ও বেলুচরা আঞ্চলিকভাবে দু’ভাগ হয়ে যায়। এ চুক্তিটির মাধ্যমে তখন আফগানিস্তান ও ব্রিটিশ ভারতের ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার লম্বা সীমানা নির্ধারণ করা হয়। তখন পাকিস্তানের জন্মই হয়নি। এ ডুরান্ড লাইন তখন দেশের ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণের চেয়ে মূলত দু’দেশের প্রভাব বিস্তারের অঞ্চল হিসেবে বেশি গুরুত্ব পায়। কিন্তু আফগানিস্তান তার আরব সাগরের তীরবর্তী বেলুচিস্তান প্রদেশকে হারায় এবং সমুদ্রের সঙ্গে একমাত্র সংযোগস্থলটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে তখন থেকেই আফগানিস্তান হয়ে পড়ে স্থলবেষ্টিত একটি দেশে।

পাকিস্তানের জন্ম মেনে নিতে পারেনি আফগানিস্তান : ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চলে বসবাসকারী পাঠানদের দৈনন্দিন জীবনে এ সীমানা তেমন কোনো প্রভাব ফেলত না। তারা বিনা বাধায় সেখানে চলাচল করতে পারত। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে ১৯৪৭ সালের পরে। যখন ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যায় এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়, অর্থাৎ আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারিত হয় ব্রিটিশদের আঁকা সেই ডুরান্ড লাইনকে ভিত্তি করে। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার প্রস্তুতিকালে আফগানিস্তান তার এ সীমানা সংশোধনের দাবি তুললেও ব্রিটেন এ বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তাই শুরুতে পাকিস্তানের জন্ম মেনে নিতে পারেনি আফগানিস্তান। এমনকি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান যখন জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার আবেদন করে, তখন একমাত্র আফগানিস্তানই তার সদস্যপদের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়। পরে অবশ্য ব্রিটেন ও আমেরিকার চাপে আফগানিস্তান ভেটো প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। কিন্তু দেশটি ডুরান্ড লাইন মেনে নেবে না বলে ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানের ভেতরের পশতুন ও বেলুচ অঞ্চলকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে। এরপর থেকে বহুবার আলোচনায় আসে এ ডুরান্ড লাইন।

পাকিস্তান-ব্রিটেন ও আমেরিকার সমর্থন নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দোহাই দিয়ে এ লাইনকেই আফগানিস্তানের সঙ্গে তার আসল সীমানা হিসেবে গণ্য করে। পরবর্তীকালে আফগানিস্তান ঘোষণা করে, ডুরান্ড লাইন চুক্তি ও অ্যাংলো-আফগান চুক্তিগুলো অকার্যকর। কেননা, আফগান শাসকরা তখন ব্রিটিশদের চাপে বাধ্য হয়েছিল চুক্তি সই করতে। স্নায়ুযুদ্ধকালে পাকিস্তান আমেরিকার মিত্র হয়ে ওঠে এবং আফগানিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা পায়। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তর শত্রুতা তখন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। এ বিরোধ ডুরান্ড লাইন সমস্যার সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া যখন আফগানিস্তান আক্রমণ করে, তখন এ মার্কিন-পাকিস্তান পক্ষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের সমর্থন দেয়। এ মুজাহিদরা ছিল মূলত পশতুন উপজাতি অঞ্চল থেকে আগত তথা পাঠান। তখন থেকেই পাকিস্তান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করে।

তালেবান প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার যত দিক : অবৈধ চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের আনাগোনা রোধকল্পে ২০১৭ সালে পাকিস্তান সরকার এ ডুরান্ড লাইন বরাবর স্থায়ী বেড়া নির্মাণকাজ শুরু করে। এরই মধ্যে ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে দাবি পাক সরকারের। অতীতের সরকারের ন্যায় বর্তমান তালেবান সরকারও পাকিস্তানের এ উদ্যোগের ঘোরবিরোধী। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাজ মুজাহিদ পাকিস্তানের সীমান্তে বেড়া নির্মাণের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের ডুরান্ড লাইন বরাবর কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার এবং লাইন বরাবর উপজাতীয়দের বিচ্ছিন্ন করার কোনো অধিকার নেই।’ ডুরান্ড লাইনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আফগানিস্তানের তালেবান প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বাড়ছে দিনের পর দিন। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখায় পাকিস্তানকে তারা বন্ধু বলে মনে করে না। অধিকন্তু বর্তমান তালেবান প্রশাসনের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশ দীর্ঘদিন পাকিস্তানের জেলে থেকেছেন। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চায়।

এদিকে ডুরান্ড লাইন মেনে নেওয়া মানে পশতুনদের সঙ্গে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। ফলে আফগান তালেবানরা পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে গড়ে ওঠা বিচ্ছিন্নবাদী টিটিপি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয়-পশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। যদিও আফগান তালেবানরা বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। পাকিস্তান অংশে বসবাসকারী বেশিরভাগ পশতুন বা পাঠান বর্তমান সীমারেখাকেই মেনে নিলেও বিচ্ছিন্নবাদী টিটিপির সশস্ত্র সংগ্রামে পাক বেশ উদ্বিগ্ন। এদিকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সংঘাতের মধ্যে প্রতিবেশী ভারতকে কাছে টানছে বর্তমান তালেবান সরকার। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর কাবুলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সমীকরণে বদল এসেছিল। তালেবান সরকারের সঙ্গে সন্তর্পণে দূরত্ব তৈরি করতে দেখা গিয়েছিল ভারতকে। সেই দৃশ্যও সম্প্রতি বদলেছে।

গত ৯ অক্টোবর থেকে পাঁচদিনের জন্য আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকির ঐতিহাসিক ভারত সফরকালে ভারত-আফগানিস্তানের কূটনীতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আমির খান মুত্তাকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। কাবুলে হামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘৪০ বছর পর আফগানিস্তানে শান্তি ও অগ্রগতি হয়েছে। আফগানদের সাহস পরীক্ষা করা উচিত নয়। যদি কেউ তা করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে জিজ্ঞেস করা; যাতে তারাই ব্যাখ্যা করে দিতে পারে যে, আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলা করলে ভালো হয় না।’ যুক্তরাষ্ট্রকে এ বার্তা দিতেও ছাড়েননি মুত্তাকি। তিনি বলেন, ‘বারগাম বিমানঘাঁটিতে অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ চলবে না।’

বিশ্লেষকদের মতে, সীমানা লাইনের বিষয়টি পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত হিসেবে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে, যা পাক-আফগান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা। অনেকে বলে থাকেন, আসলে পাকিস্তানের জন্য একটা অস্থিতিশীল আফগানিস্তান মন্দের ভালো। কেননা, আফগানিস্তান যত স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হবে, ডুরান্ড লাইন নিয়ে ততই সোচ্চার হবে। আর শক্তিশালী আফগানিস্তানের ডুরান্ড লাইন না মানার অর্থ হলো, পাকিস্তানের অস্তিত্ব ধরে টান দেওয়া।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত