প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ অক্টোবর, ২০২৫
সমকালীন ইতিহাসের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ইন্দিরা গান্ধী ও প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অথরিটির প্রবাদপ্রতিম নেতা ইয়াসিরের মধ্যে অসম্ভব পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। আরাফাত ইন্দিরাকে ‘বড় বোন’ সম্বোধন করতেন। ইন্দিরার সময়ে দিল্লিতে যে নির্জোট আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, তাতে তিনি ‘রাষ্ট্রনেতা’ হিসেবে উদ্বোধনী ভাষণ পর্যন্ত দিয়েছেন। সেই আস্থা ও বন্ধুত্ব শুধু ব্যক্তিগত পরিসরেই নয়, ভারতীয় ও ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়েছিল। ভারতের জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত মোহনদাস গান্ধী থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু বা তার কন্যা ইন্দিরা প্রত্যেকেই চিরকাল ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে যে ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেই জমিতে মর্যাদার সঙ্গে তাদের বাঁচার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকেই শত শত ফিলিস্তিনি ছাত্র প্রতিবছর বৃত্তি নিয়ে ভারতে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসত। ভারতের নিজের আর্থিক অবস্থা যা-ই হোক, ফিলিস্তিনে ত্রাণ, রসদ ও সহায়তা পাঠানো হতো। এ ধারা পুরো মাত্রায় বজায় ছিল ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত।
জাতিসংঘে পার্টিশন প্ল্যানেও ভারতের আপত্তি ছিল : স্বাধীন ভারতের আটাত্তর বছর ইতিহাসের অধিকাংশ সময়জুড়েই ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সারা বিশ্বের নির্যাতিতদের পাশে থেকেছে। এ অবস্থানের পক্ষে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ছিল ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের অব্যাহত সংহতি। দিল্লি শুধু ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকেই স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারেও বরাবর সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের বয়স যখন মাস তিনেক, তখন তারা জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে টুকরো করার ‘পার্টিশন প্ল্যানে’ আপত্তি জানায়। জাতিসংঘে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করে। ফিলিস্তিন ও ভারত উভয়েরই যে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের অভিন্ন ইতিহাস, দিল্লির এ নীতিগত অবস্থানের বীজ সম্ভবত নিহিত ছিল সেই বাস্তবতাতেই। এ কারণেই আরব বিশ্বের বাইরে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে সবচেয়ে জোরালো আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতেও ভারতের দেরি হয়নি। ১৯৭৪ সালে বিশ্বের প্রথম নন-আরব রাষ্ট্র হিসেবেও ভারত পিএলও-কে ফিলিস্তিনি জনতার একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরের বছরই দিল্লিতে চালু হয় পিএলও-এর কার্যালয়। এমনকি ১৯৮৮ সালের ১৮ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় ভারত। যার কয়েক বছর পর পশ্চিম তীরের রামাল্লায় চালু হয় ভারতীয় দূতাবাস। টেকনিক্যাল কারণে সেটিকে অবশ্য দূতাবাস না বলে ভারতের প্রতিনিধি কার্যালয় বলাটাই রেওয়াজ।
ফিলিস্তিনের বন্ধুত্ব থেকে ইসরায়েলের বন্ধুত্বের গল্প : এ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে বলেই গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভারতের নীরবতা এবং ইসরায়েলের নিন্দা জানানোর ব্যর্থতা দেশ-বিদেশের বহু পর্যবেক্ষককে স্তম্ভিত করেছে। এমনকি ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়ে জাতিসংঘে আনা চারটি বড় প্রস্তাবেও ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে। কারণ দেখানো হয়েছে, সহিংসতার সূচনা যে হামাসের হাতে, সেটা কেন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। নিজেদের গ্লোবাল সাউথের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় দেখতে চাইলেও এ প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ছিল স্পষ্টতই অন্য সতীর্থদের চেয়ে ভিন্ন। ঐতিহাসিক জোয়া হাসানের মতে, ভারতের এ নীরবতা শুধু চরম নৈতিক ব্যর্থতাই নয়, নিজেদেরই রাষ্ট্রীয় লিগ্যাসির সঙ্গে এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।’ যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন এক সময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ ছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে সেই স্তম্ভকেই ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নয়, ভারতের আমজনতা বা সাধারণ মানুষও আজ ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছেন। যে কারণে দেশের কোনো প্রান্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো টুঁ শব্দও হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে এ নাটকীয় পটপরিবর্তন সম্পন্ন হলো কী করে? বহির্বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারত কীভাবে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ইসরায়েলের সঙ্গে নির্দ্বিধায় হাত মেলাল?
ইসরায়েলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট : ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় যখন, সেই ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকেই ভারতের ফিলিস্তিন নীতিতে এ পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে। ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ও আমেরিকাতে নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। রণেন সেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইসরায়েলকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার এ পদক্ষেপের সূচনা হয়েছিল নিউইয়র্কে। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষেদের অধিবেশনের সাইডলাইনে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের বৈঠক হয়েছিল। বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রতি শিমন পেরেজের অঙ্গীকার রাজিব গান্ধীকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। শিমন পেরেজ তাকে বোঝাতে পেরেছিলেন, ভারত যেমন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে গণতন্ত্রের একমাত্র দ্বীপ কিংবা জাপান পূর্ব এশিয়াতে, তেমনি ইসরায়েলও পশ্চিম এশিয়াতে তেমন। ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে উভয় দেশই যে উপকৃত হবে, দুই নেতাই সে ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। এরপরই পরবর্তী চার বছরে যেন এ লক্ষ্য অর্জন করা যায়, সেজন্য একটি রোডম্যাপ করতে রণেন সেনকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। এ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল ডেভিস কাপ টেনিসের ম্যাচগুলোতে ইসরায়েলের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা, ভারতের মাটিতে যেসব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাগুলো হতো, তাতে ইসরায়েলি প্যাভিলিয়নে তাদের পতাকা রাখা, বোম্বে শহরে ইসরায়েলি কনস্যুলেটকে আপগ্রেড করে তাদের কাজের পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি। তবে রাজিব গান্ধী ১৯৮৯-এর নির্বাচনে হারার পর ভিপি সিং ও চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে যে দুটি স্বল্পমেয়াদি সরকার দেশের ক্ষমতায় এসেছিল, তারা কেউই এ উদ্যোগ নিয়ে এগোনোর বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। ইসরায়েল অবশেষ পরবর্তী কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাওয়ের আমলে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতি পায়।
আরাফাতকে পাশে বসিয়েই ইসরায়েলের স্বীকৃতি : ভারত যখন অবশেষে ইসরায়েলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়, তার ঠিক আগে পিএলও-এর অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার তখন লোকসভায় দলের এমপি, ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে তার কিছুকাল আগেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। সেই আইয়ার সম্প্রতি একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, আরাফাতের সেই সফরে তার সঙ্গে ফিলিস্তিনি নেতার একান্তে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। চারদিকে শোনা যাচ্ছিল, নরসিমহা রাও ইসরায়েলকে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে চলেছেন। আইয়ার লিখেছেন, আরাফাতকে বললাম, একমাত্র আপনিই পারেন ভারতকে এ বিপর্যয়ের পথে যাওয়া থেকে ঠেকাতে। আরাফাত আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন, কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না। পরদিন আমি অসহায় হয়ে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আপগ্রেড করার কথা ঘোষণা করছেন। ঠিক তার পাশে বসা ইয়াসির আরাফাত সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তখন বিশ্বে খুব কম লোকই জানতেন, নরওয়ের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের মধ্যে গোপন আলোচনা চলছে। বিখ্যাত অসলো চুক্তিও ততদিনে চূড়ান্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
১৯৯৩ সালের সেই অসলো চুক্তিই তিউনিশিয়াতে নির্বাসিত জীবন থেকে আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও-এর গাজা ও পশ্চিম তীরে ফেরার পথ প্রশস্ত করে। তবে চুক্তিতে ইসরায়েল আরও যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার অনেকগুলোই পরে রক্ষিত হয়নি। ইয়াসির হয়তো তখন ভেবেছিলেন, ভারত যদি ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তাহলে সম্ভবত ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের প্রতিশ্রুত দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান অর্জনে ফিলিস্তিনের সুবিধা হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা তো হয়নি; উল্টো ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ভারতের কাছ থেকে ফিলিস্তিনিদের দূরত্ব বাড়িয়েছে।
ভারতের নৈতিকতার তীরই দিকভ্রষ্ট : দিল্লির জেএনইউ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমেরিটাস অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ জোয়া হাসানের পর্যবেক্ষণ, ১৯৯২-এর পর থেকেই ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের সমর্থনে ভাঁটা পড়তে শুরু করে। তবে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তা মারাত্মক মোড় নেয়। জাতীয় স্বার্থ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক বাস্তববাদের দোহাই দিয়ে ভারতে একটার পর একটা সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধের পর থেকেই ভারত যখন তাদের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বাড়াতে ইসরায়েল থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি শুরু করে, এ ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। এখন ক্রমে ক্রমে ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ক্রেতায় পরিণত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে ভারত ও ফিলিস্তিনের বহু বছরের আস্থার সম্পর্ক। মোদীর বিজেপি সরকারের আমলে ভারত-ইসরায়েলের এ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ একটা ভিন্ন মাত্রা নিতে থাকে। ইসরায়েলি ব্র্যান্ডের হার্ডলাইন জাতীয়তাবাদ ও সিকিউরিটি-ফার্স্ট ডকট্রিনকে ভারতও ক্রমশ আরও বেশি আঁকড়ে ধরতে শুরু করে। বিগত বহু দশক ধরে ভারত যে নৈতিকতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে অবস্থান নেওয়ায় বিশ্বাসী ছিল, সেখান থেকেই তারা ধীরে ধরে সরে আসে। এরই পরিণতিতে বিশেষত গত দু’বছর ধরে গাজার ওপর যখন প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয় নেমে এসেছে, ৫৫ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়েছেন, শরণার্থী শিবির বা হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে কিংবা খাদ্য-পানীয় জল বা ওষুধের সরবরাহ পর্যন্ত ছিন্ন করা হয়েছে, ভারত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি। ভারত যাতে তাদের ফিলিস্তিনপন্থি পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরে আসে, তার জন্যও দেশের জনমতে বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যে তেমন কোনো জোরালো দাবিও নেই। ভারতের রাজনীতি যেমন দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকেছে, তেমনি ইসরায়েলকে নিয়ে ভারতের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও যথারীতি বিবর্তিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত ঠিক দু’বছর আগেই আহমদাবাদে বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সময় ভারতীয় দর্শকরা মাঠে ইসরায়েলের সমর্থনে শ্লোগান দিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে সঙ্গে সঙ্গে সেসব ছবি পোস্ট করে উল্লাস জানিয়েছিলেন দিল্লিতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত। সাম্প্রতিক এক পিউ রিসার্চ জরিপেও দেখা গেছে, অন্তত ৩৪ শতাংশ ভারতীয় গাজাতে ইসরায়েলের হামলাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাচ্ছেন। যেখানে ইসরায়েলের ভূমিকায় আপত্তি আছে ২৯ শতাংশ ভারতীয়ের। ওই সার্ভে দেখিয়েছে, ভারতে ইসরায়েলের সমর্থকের সংখ্যা আসলে বহু পশ্চিমা দেশের চেয়েও অনেক বেশি।
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আর জনমত নেই ভারতের : ভারতের বুকার পুরস্কার জয়ী লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি নিউইয়র্কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, বছর কয়েক আগেও ফিলিস্তিনি জনতার সংগ্রামে ভারতের সাধারণ মানুষের যে সমর্থন আর ভালোবাসা ছিল, তা এখন পুরোপুরি নেই। জিটিও-এর মেহদি হাসানের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি তার কিছুদিন আগের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন। অরুন্ধতী রায় জানান, আমি বেইরুটে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ফিলিস্তিন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান পাল্টে গেছে, এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। ওরা অনেকেই তখন বললেন, তোমাদের দেশে সরকার বদলেছে, তাদের অবস্থান হয়তো বদলেছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ নিশ্চয় এখনও আমাদের ভালোবাসেন। তখন তাদের ভুলটা ভাঙাতেই হলো। বলতেই হলো কুড়ি বছর আগে হয়তো বাসতেন, কিন্তু এখন আর বাসেন না। অরুন্ধতী রায় আসলে বিশ্বাস করেন, আগে ফিলিস্তিনের বন্ধু রাষ্ট্র হলেও ভারত এখন আর তাদের বন্ধু নয়; নিপীড়িত মানুষের সঙ্গী হিসেবে ভারতের যে মর্যাদার জায়গা ছিল, সেটাও তারা খুইয়েছে। মেহদি হাসানকে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, গাজায় ইসরায়েলের এমন বিধ্বংসী হামলার পর ভারতে তার কোনো প্রতিবাদ হয়নি বললেই চলে। যদি ধরি মাত্র জনাকুড়ি লোকও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে একজোট হয়, তাহলে পুলিশ বা প্রশাসনকে এসে ওটা ভাঙতে হবে না। তার আগে রাস্তার সাধারণ মানুষই এসে ওটা ছত্রভঙ্গ করে দেবে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও ইসরায়েলের ইহুদিবাদী জাওনিজমের মধ্যে যে আদর্শগত সাদৃশ্য, সেই মিলটাই এ দুই শক্তিকে ক্রমশ কাছাকাছি এনেছে। প্রায় আশি শতাংশ হিন্দুর দেশ ভারতের প্রায় একশো শতাংশ মুসলিমণ্ডঅধ্যুষিত ফিলিস্তিনকে সমর্থন করতে স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চাশ বছর অন্তত কোনো সমস্যা হয়নি। রাষ্ট্রীয় নীতিতেও তখন আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা, নৈতিকতা বা মানবিকতারই প্রাধান্য ছিল; কিন্তু ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই এখন মানেন, ধর্মের সেই ব্যবধান আজ ফিলিস্তিনি ও ভারতীয়দের মধ্যে দূরত্ব তৈরিতে বিরাট ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। ভারতের আমজনতার বড় অংশ ফিলিস্তিনকেও ইসরায়েলের চোখ দিয়েই দেখতে শুরু করেছে।
লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী