ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মমতার ইতিবৃত্ত

* গাজার হাসপাতাল সূত্র আল-জাজিরাকে বলেছে, কয়েকটি লাশে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ বলেন, তাদের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, তারা যখন বাধা দিয়েছেন, তখন তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে
ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মমতার ইতিবৃত্ত

ইসরায়েলের কারাগারে আট মাস বন্দি থাকা মাহমুদ আবু ফউল মুক্তি পাওয়ার পর মায়ের গলা শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু এ ফিলিস্তিনি তরুণ মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। মাহমুদের বয়স ২৮ বছর, বাড়ি গাজার উত্তরাঞ্চলে। গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে কামাল আদওয়ান হাসপাতাল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এরপর থেকে তিনি ইসরায়েলের বন্দিশালায় ছিলেন। কারারক্ষীরা তাকে এতটাই নির্যাতন ও নিষ্ঠুরভাবে মারধর করেছেন, তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীন এ সপ্তাহে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের অনেকের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে।

মাহমুদ ২০১৫ সালে ইসরায়েলের বোমা হামলায় পা হারান। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, বন্দি থাকার সময় তাকে অবিরাম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। রাখা হয় ইসরায়েলের কুখ্যাত সদে তেইমান কারাগারে। আরও অনেক বন্দি এ কারাগারে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। মাহমুদ বলেছেন, তাকে ওই কারাগারে প্রচণ্ড নির্যাতন ও মারধর করা হতো। এমন একদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মাহমুদ বলেন, কারারক্ষীরা সেদিন তার মাথায় এত জোরে আঘাত করেন, তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। মাহমুদ আরও বলেন, আমি বারবার আমাকে চিকিৎসা করাতে বলছিলাম। কিন্তু তারা শুধু আমার চোখে একধরনের ড্রপ দিয়েছেন, যেটি কোনো কাজই করেনি। আমার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছিল, ময়লা বেরোচ্ছিল ও ব্যথা করছিল। কিন্তু তারা গুরুত্ব দেননি। চিকিৎসা পেতে মাহমুদ অনশনের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তার দাবি আমলেই নেয়নি।

অবশেষে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মাহমুদকে নাসের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি পরিবারের দেখা পেতে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেখানে তার মা আসেন। মাহমুদ বলেন, মায়ের গলা শুনেই আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে শুধু গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়াটাও আমার কাছে পুরো পৃথিবী পাওয়ার সমান। মাহমুদ এখন গাজায় বাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে একটি তাঁবুতে বসবাস করছেন। এখনও তার চোখের চিকিৎসা হয়নি। চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে তিনি সাহায্য কামনা করেছেন। ইসরায়েলি কারাগারে বন্দীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের প্রমাণ ক্রমে বাড়ছে। মাহমুদ যেসব নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলো ওইসব প্রমাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ইসরায়েলের কারাগার থেকে এ সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের অনেককে দুর্বল ও অসুস্থ মনে হয়েছে বা তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। একজনের ওজন তার বন্দি হওয়ার আগের ওজনের অর্ধেক হয়ে গেছে। প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বন্দি থাকা ১০০ সাবেক ফিলিস্তিনি বন্দির সাক্ষ্য নথিবদ্ধ করেছে। তারা দেখেছে, শুধু সদে তেইমানের মতো কুখ্যাত বন্দিশালাতেই নয়; বরং ইসরায়েলের সব কারাগারে পদ্ধতিগতভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়।

ফলিস্তিনি বন্দিদের বিচারক, আইনজীবী অথবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয় না। তাদের সব অধিকার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ইসরায়েল অন্তত ১০০ ফিলিস্তিনির মরদেহ ফিরিয়ে দিয়েছে, যারা বন্দি থাকার সময় মারা গেছেন। গাজার হাসপাতাল সূত্র আল-জাজিরাকে বলেছে, কয়েকটি লাশে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ বলেন, তাদের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, তারা যখন বাধা দিয়েছেন, তখন তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৭৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দি ইসরায়েলি কারাগারে মারা গেছেন।ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা বেইতসালেম গত বছর দেশটির কারাগার ব্যবস্থাকে ‘নির্যাতন শিবিরের জাল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে বন্দিরা পদ্ধতিগতভাবে শারীরিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন। কারাগারগুলোয় বন্দিদের যথেষ্ট খাবার ও চিকিৎসা দেওয়া হয় না এবং তারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েল (পিসিএটিআই) বলেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে বন্দি নির্যাতনের শতাধিক ঘটনার প্রতিবেদন দেওয়া হলেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ শুধু দুটি ঘটনা আইনের আওতায় এনেছে। তবে দুই মামলার কোনোটিতে কোনো কারাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়নি। পিসিএটিআই বন্দি নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করা একটি ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন। ইসরায়েলের ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের প্রতিষ্ঠাতা রুচামা মার্টন বলেন, তিনি দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছেন। কিন্তু নির্যাতন বন্ধে ব্যর্থ হয়েছেন। ইসরায়েলের দৈনিক পত্রিকা হারেৎজকে রুচামা বলেন, হয়তো মানুষ আর এটি অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে এটি তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ইসরায়েলের উগ্র দক্ষিণপন্থি জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতি কঠোর আচরণের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি দেশটির কারাগার পরিচালনা ব্যবস্থার তদারকি করেন। এখনও প্রায় ৯ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি কারাগারে রয়েছেন। তাদের অনেকেরই বিচার হয়নি বা কোনো নিয়মিত আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। ইসরায়েল পদ্ধতিগতভাবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা এসব অভিযোগ খণ্ডন করার মতো কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও কারা কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত