ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উম্মতের প্রতি রাসুলের অকৃত্রিম ভালোবাসা

মুফতি জাওয়াদ তাহের
উম্মতের প্রতি রাসুলের অকৃত্রিম ভালোবাসা

একটি প্রসিদ্ধ হাদিস আমরা সবাই জানি, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই।’

আমরা দেখি একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ভালোবাসার কিছু কারণ থাকে। ফলে সহজেই তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা জন্মে যায়। কেউ যদি আপনাকে ধারণাতীত ভালোবেসে আপনার হিতাকাক্সক্ষী হয়, তখন আপনিও তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হবেন। আমাদের নবী আমাদের কতটা ভালোবাসতেন এ বিষয়টা আমাদের জানা থাকলে রাসুলের প্রতি আমারও সেই রকম ভালোবাসা জন্মাবে। ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে এমন কিছু বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা পড়ার দ্বারা যে কোনো পাঠকের তার প্রতি ভালোবাসে জন্মাবে। এ কারণেই আমরা দেখি বিধর্মী হয়েও রাসুলের জীবনী লিখে অনেকে নিজেকে ধন্য মনে করে।

উম্মতকে সঠিক পথে আনার জন্য রাসুল (সা.) নিজেকে এতটাই উজাড় করে দিয়েছেন, যা দেখে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেছেন, ‘হে নবী আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আপনার ওপর কোরআন নাজিল করিনি।’ (সুরা ত্বহা : ২)।

নিজের যত কষ্টই হোক একজন উম্মত কোনোভাবেই যেন জাহান্নামি না হয়, দরদি নবীর এটাই ছিল কামনা। তায়েফের ময়দানে রাসুলের ওপর সেই বর্বর হামলার পর যখন পর্বতমালার ফেরেশতা রাসুল (সা.) কে আওয়াজ দিলেন এবং সালাম দিয়ে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনার কওম আপনাকে যা করেছে, তার (সবই) মহান আল্লাহ দেখেছেন। আমি হচ্ছি পর্বতমালার ফেরেশতা। আমার প্রভু আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আমাকে তাদের ব্যাপারে (কোনো) নির্দেশ দেন। সুতরাং আপনি কী চান? আপনি চাইলে, আমি (মক্কার) বড় বড় পাহাড় দুটিকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেব।’ (এ কথা শুনে) নবীজি (সা.) বললেন, (এমন কাজ করবেন না) বরং আমি আশা করছি, মহান আল্লাহ তাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। (বোখারি : ৩২৩১)।

ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি যেন (এখনও) রাসুল (সা.) কে নবীদের মধ্যে এক নবীর ঘটনা বর্ণনা করতে দেখছি, তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে, আর তিনি তাঁর চেহারা থেকে রক্ত মুছছেন এবং বলছেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করে দাও। কেননা তারা অজ্ঞ। (বোখারি : ৩৪৭৭)।

মহান আল্লাহ তায়ালা উম্মতের প্রতি রাসুলের দয়ার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তরজমা ‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের ব্যথায় কষ্ট পান, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মোমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা : ১২৮)।

তিনি আমাদের যে কোনো কষ্টে ব্যথা অনুভব করেন। রাসুল (সা.) কে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম দেখিয়েছেন, জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তাঁকে জানিয়েছেন, তাই তিনি কখনও এ কামনা করতেন না, তার উম্মতের কেউ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে জাহান্নামি হোক। কেউ রাসুলের ডাকে সাড়া দিয়ে ঈমান আনলে তিনি কতটা উচ্ছ্বসিত হতেন তা এই চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি বালক নবী (সা.) এর খেদমত করত, সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী (সা.) তাকে দেখার জন্য এলেন। তিনি তার মাথার কাছে বসে তাকে বললেন : তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, সে তখন তার পিতার দিকে তাকাল, যে তার কাছেই ছিল, পিতা তাকে বলল, আবুল কাসেম (নবী (সা.) এর কুনিয়াত) এর কথা মেনে নাও, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। নবী (সা.) সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় এরশাদ করলেন : সব প্রশংসা সে আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (বোখারি : ১৩৫৬)।

এক হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইবরাহিম (আ.) এর কথা তেলাওয়াত করলেন, ‘হে আমার রব, তারা অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে, তাই যারা আমার অনুসরণ করবে তারা আমার দলভুক্ত, আর যারা আমার অবাধ্য হবে (তাদের ব্যাপারে) আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা : ইবরাহিম : ৩৬)।

আর ঈসা (আ.) বলেছেন, আপনি তাদের আজাব দিলে তারা আপনার বান্দা, আর ক্ষমা করলে আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মায়েদা : ১১৮)।

অতঃপর রাসুল (সা.) দুই হাত তুলে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘হে জিবরাইল, মুহাম্মদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আপনি কাঁদছেন কেন?’ অথচ মহান আল্লাহ সব কিছুই অবগত আছেন। জিবরাইল (আ.) এসে জিজ্ঞেস করলেন। রাসুল (সা.) তাকে নিজের কথা বললেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে জিবরাইল, তুমি মুহাম্মদের কাছে গিয়ে বল, আমি অচিরেই আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আমি আপনাকে কষ্ট দেব না।’ (মুসলিম : ২০২)।

তিনিই আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) যিনি কেয়ামতের ময়দানে সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে বলতে থাকবেন ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি। যেখানে অন্য সব নবী বলবেন, ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমার ও তোমাদের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালিয়েছে। আর পতঙ্গ ও ফড়িং তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আর সে ওইগুলোকে আগুন থেকে ফিরিয়ে রাখতে চাচ্ছে। তো আমিও তোমাদের কোমর ধরে তোমাদের আগুন থেকে ফিরিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু তোমরা আমার হাত থেকে ফসকে যাও।’ (মুসলিম : ৬০৯৮)।

রাসুল (সা.) তাঁর বিশেষ দোয়াটিও নিজের গোনাহগার উম্মতের সংকটময় অবস্থার জন্য রেখে দিয়েছেন। কেননা রহমতের নবী রাসুল (সা.) গোনাহগার উম্মতের প্রতি বিশেষ স্নেহশীল ছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সব নবীর এমন কিছু দোয়া ছিল, যা আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছে। সব নবী দ্রুত নিজেদের জন্য দোয়া করেছে। আমি তা কেয়ামতের দিন উম্মতের সুপারিশের জন্য গোপন করে রেখেছি। আমার উম্মতের মধ্যে যে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে ইনশাআল্লাহ আমার সুপারিশ লাভ করবে।’ (মুসলিম : ১৯৯)।

যে নবী আমাদের এতটা ভালোবাসেন কখনও কি তাঁর কথা একটু নীরবে-নিভৃতে ভেবে দেখেছি? সেই নবীর উম্মত হয়েও প্রতিনিয়ত তার অবাধ্যতায় লিপ্ত রয়েছি। আমার নাফরমানির কারণে দয়ার নবী কষ্ট পাবেন, একথা কি কখনও চিন্তা করেছি? পৃথিবীর অন্য কোনো মহামানবের ভেতরে এমন অপূর্ব দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না, যার সমাহার ও সংমিশ্রণ শুধু এ মহামানবের জীবনাদর্শেই বিদ্যমান। তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করার মধ্যে আমাদের জীবনের সব সফলতা নিহিত। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন তাঁকে ভালোবাসার, তাঁর অনুসারী হওয়ার আমিন!

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস

সালাম, বিমানবন্দর ঢাকা-১২৩০

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত