যুবশক্তির বিকাশে বাংলাদেশের জাতীয় কর্মনীতি জরুরি। প্রয়োজন এমন এক ডকট্টিন- যা রাজনৈতিক-বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থানভিত্তিক নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সে হবে নৈতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, ভূরাজনৈতিক ও সভ্যতাগত ভবিষ্যৎ নির্মাণে যুবকদের কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত করার দৃষ্টিভঙ্গি।
একটি ইতিবাচক, সংগঠিত ও নীতিনিষ্ঠ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে হবে যুবশক্তিকে। এজন্য শুধু চেতনার উদ্দীপনা নয়, প্রয়োজন গভীর দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে একটি নৈতিক, জ্ঞানভিত্তিক ও সাংগঠনিক রূপকল্প। এর দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে কতিপয় দিকবিবেচনা জরুরি।
১. বাংলাদেশে বহু তরুণ রাজনৈতিক ‘নেতৃত্ব’-এর আকাঙ্ক্ষায় আকৃষ্ট হন। কিন্তু নেতৃত্বের প্রকৃত অর্থ- দায়িত্ব গ্রহণ, সেবাপ্রদান, ত্যাগ স্বীকার। সেটা আয়ত্ত না করলে নেতৃত্বের আগ্রহ পথ হারায়। এখানে নেতৃত্ব বলতে বোঝায় শুধু বক্তৃতা, ক্যামেরার সামনে উপস্থিতি বা প্রতীকী উচ্চারণ। এর বদলে যুবশক্তিকে শেখাতে হবে দায়িত্ব গ্রহণের মনোভাব- নিজের পরিবারের, সমাজের। তাকে রাষ্ট্রের, ভবিষ্যতের দায়িত্ব গ্রহণের সক্ষমতা নির্মাণ করতে হবে। একজন তরুণ যখন রাস্তার গর্তে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেন, তখন তিনি নেতা না হলেও সমাজের নায়ক হতে যাচ্ছেন।
২. শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জনের সংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানচর্চা- চিন্তা, পাঠ, গবেষণা, বিতর্ক ও প্রয়োগ বলতে গেলে অনুপস্থিত। বিকাশকামী তারুণ্যের জন্য জরুরি হলো, শুধু সার্টিফিকেট অর্জন নয়, বরং গতিশীল ও বর্তমান জ্ঞান-সংস্কৃতি গড়ে তোলা। ডিগ্রি সমাজে চাকরি এনে দিতে পারে; কিন্তু সমাজকে বদলাতে পারে চিন্তা, প্রজ্ঞা ও বিচারের গভীরতা।
৩. বাংলাদেশে রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যার প্রতিক্রিয়ায় তরুণরা সজাগ। তাদের বিক্ষোভ বলতে গেলে চলমান। কিন্তু সেই বিক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়াগুলোর ভবিষ্যৎপ্রসারী কাঠামো ও দিকনির্দেশনা কোথায়? বিকাশকামী যুবশক্তি শুধু প্রতিক্রিয়ায় নয়, বরং নিজের দক্ষতার গঠনমূলক বিকাশ ঘটাবে সমাজ-দর্শনে, প্রযুক্তিতে, পরিবেশে, নীতি ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণে। ...এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে। মনে রাখতে হবে প্রতিক্রিয়া আগুন জ্বালায়, বিকাশ আগামীর পথ দেখায়।
৪. তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ থাকলেও, সেই আশা অনেক সময় সুবিধাবাদী বা স্বপ্ননির্ভর হয়ে পড়ে। পরিবর্তনের জন্য শুধু আবেগ নয়, দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকার প্রয়োজন। প্রয়োজন সময়নিষ্ঠতা, আত্মসংযম, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা। যে তরুণ স্বপ্ন দেখে সে আশাবাদী বটে, কিন্তু যে তরুণ নিয়মিত ঘাম ঝরায়, সে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে।
৫. পরিবর্তন চাই- এই স্লোগান দিয়ে অনেক আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু পরিবর্তনের পথরেখা, কৌশল ও প্রক্রিয়া থাকে অনুপস্থিত। মনে রাখতে হবে পরিবর্তনের পূর্বশর্ত হলো পদ্ধতি। যুবশক্তির কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে, কীভাবে সমস্যার গোড়ায় পৌঁছতে হয়, কীভাবে স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত বিকল্প পথ তৈরি হয়। পরিবর্তন হঠাৎ হয় না- তা গঠিত হয় কাঠামো, কৌশল, ধারাবাহিকতা আর নিষ্ঠার সমন্বয়ে। নেতৃত্ব মানে শুধু পদ নয়- ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, দৃষ্টি ও দায় নেওয়া। উদ্ভাবন মানে শুধু প্রযুক্তি নয়- চিন্তার কাঠামো, নীতির ভাষা ও বাস্তবতাণ্ডনির্মাণের ক্ষমতা। আমরা চাই দক্ষ যুব নেতৃত্ব। এই দক্ষতাকে দূরদৃষ্টি ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কৌশলগত নেতৃত্বে রূপান্তরিত করার দায়ও রাষ্ট্রের। এজন্য প্রয়োজন এমন যুবরূপরেখা- যা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথার্থ ও অগ্রসর।
যুবশক্তির বিকাশে আমরা যদি ডকট্টিন নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে তার মুখ্য স্তম্ভগুলোকে মাথায় রাখতে হবে। যা বাস্তবায়নযোগ্য কর্মধারা প্রস্তাব করবে।
১. চেতনার বিপ্লব : এ হচ্ছে মৌলিক রূপান্তরমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা শুধু বাহ্যিক উন্নয়ন নয়, বরং অন্তরচক্ষুর জাগরণকে কেন্দ্র করে গঠিত। এই স্তম্ভ জাতিকে এক বৈপ্লবিক বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণে নেতৃত্ব দিতে পারে- যেখানে যুবসমাজ হবে আত্মজাগরিত, ঐতিহাসিকভাবে সংবেদনশীল এবং ন্যায়ের জন্য দায়বদ্ধ। এ স্তম্ভের তিনটি প্রধান উপাদানের দিকে খেয়াল রাখতে হবে বিশেষভাবে।
ক. শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হবে চিন্তার শক্তি ও নৈতিক স্পষ্টতা।
* বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ডিগ্রি-কেন্দ্রিক এবং পরীক্ষানির্ভর এক ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ। এতে জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মবিকাশ ও নৈতিক জিজ্ঞাসা প্রায় অনুপস্থিত।
* চিন্তার শক্তি মানে আত্মবিশ্লেষণের ক্ষমতা, জিজ্ঞাসাকে ধারণ করার সাহস এবং তত্ত্ব থেকে কর্মে রূপায়নের বুদ্ধি।
* নৈতিক স্পষ্টতা মানে নিছক বাইনারি নয়, বরং ন্যায়ের সূক্ষ্মতাকে বুঝে কাজ করার সাহস। এটি যুক্তিবাদ গঠনের জন্য নয়, বরং মূল্যবোধভিত্তিক চিন্তার ভিত্তিকে অবলম্বন ও চর্চার জন্য।
অতএব শিক্ষার প্রতিটি স্তরে নাগরিক দর্শন, আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ এবং তর্ক ও সহনশীলতার মতো বিষয়কে পাঠ্যকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
খ. জাতীয় পর্যায়ে Youth Philosophy Movement : এই মুভমেন্টের কথা বলছি, কারণ-
* জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মপরিচয় ও রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে যুবকদের চিন্তাকে সক্রিয় করা জরুরি।
* বাংলাদেশে এক চিন্তাগত নবজাগরণ সংগঠিত করতে হবে, যার কেন্দ্রে থাকবে যুবচিন্তা। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাসংঘ গঠন করে সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ভাবনার অনুশীলন করা। কিন্তু তা শুধু বিদ্যালয়কেন্দ্রিক হলে চলবে না। সমাজের আরও তৃণমূলে একটা সবল-সক্রিয় সম্ভাবনার মধ্যেও এর বাণী ও বার্তাকে তাদের মতো করে চারিয়ে দিতে হবে। স্বতন্ত্র চিন্তার স্বীকৃতি দিতে শিখতে হবে- যেখানে তরুণরা শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের জন্য নয়, সমাজের নৈতিক অবকাঠামো গঠন-পুনর্গঠনে যুক্ত হবে। এমনতরো আন্দোলন হবে একটি অনুশীলনভিত্তিক, চিন্তাকেন্দ্রিক জাতীয় রূপান্তরমূলক প্ল্যাটফর্ম।
গ. যুবকদের মাঝে চেতনাবোধের বীজ রোপণ। তাদের অন্তর ও চিন্তার গভীরে এমন ধারণা, মূল্যবোধ ও বোধসম্পন্ন বুদ্ধি স্থাপন করা, যা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠবে এবং ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত, আচরণ ও রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তি গড়ে দেবে। যেমন- আত্মবোধ, কালের বোধ, ন্যায়বোধ। আত্মবোধ মানুষকে জাগাবে, কালের বোধ মানুষকে দায় বুঝাবে, আর ন্যায়বোধ মানুষকে সততার যোদ্ধা বানাবে।
২. দ্ব্যর্থহীন দক্ষতা (Skill without Subservience) : স্তম্ভটি বাংলাদেশের যুবশক্তিকে এমন দক্ষতা, অন্তর্দৃষ্টি ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতায়ন দেওয়ার প্রস্তাব করে, যা একদিকে আত্মনির্ভরতা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে জাতিকে পরাধীনতা-মুক্ত, টেকসই ও নেতৃত্বদানকারী ভবিষ্যতের পথে পরিচালিত করবে। দ্ব্যর্থহীন কথাটা বলছি, কারণ সে বলছে- দক্ষতা হবে স্বচ্ছ, স্বাধীন এবং লক্ষ্যনির্ভর, কোনো প্রভুভক্ত মানসিকতা থেকে তা হবে না। কিংবা নিছক চাকরিপ্রার্থী সত্তায় আটকে থাকলে দ্ব্যর্থহীন দক্ষতা আসবে না।
এই দক্ষতা গঠনের কাঠামো হবে কয়েক স্থরের। যা যুবশক্তিকে প্রযুক্তিগতভাবে যেমন সক্ষম করবে, তেমনি নৈতিক, কৌশলগত ও বিশ্বদৃষ্টিসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রণীত হবে। স্তরগুলোর মধ্যে আছে-
ক. কঠিন বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা : এই স্তরের উদ্দেশ্য হবে প্রযুক্তির ওপর কর্তৃত্ব ও প্রয়োগক্ষমতা অর্জন। এই দক্ষতাগুলো বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কেন্দ্রে অবস্থিত। বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক শ্রমবাজার, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশ নিতে চায়, তাহলে Hard Skills -এ অগ্রসর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অপরদিকে এই দক্ষতা Precision Farming-এর মাধ্যমে কৃষিজ রূপান্তর ঘটবে- যেখানে কম জমিতে, কম পানিতে, অধিক উৎপাদন সম্ভব।
খ. নৈতিক ও আন্তঃসম্পর্ক দক্ষতা : এই দক্ষতার উদ্দেশ্য হবে, মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন। Hard Skills দক্ষ জনবল তৈরি করে; কিন্তু Soft Skills নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও সামাজিক বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি গড়ে তোলে। এই স্তরের দক্ষতা ছাড়া প্রযুক্তির বর্বর চর্চা হবে। যেমন অও দিয়ে নজরদারি, রোবট দিয়ে যুদ্ধ। নৈতিকতা ছাড়া দক্ষতা-প্রযুক্তি শক্তি হতে পারে; কিন্তু মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধি কিংবা শান্তি আনতে পারে না।
গ. কৌশলগত ও ভবিষ্যত-সংবেদনশীল দক্ষতা : এই দক্ষতার উদ্দেশ্য হবে ভবিষ্যতের বিশ্বে নেতৃত্বদানের জন্য দূরদৃষ্টি ও পরিপক্বতা তৈরি করা। এই স্তরে Geo-economics বা Cyber Strategy এর মতো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে। যা তরুণদের গ্লোবাল ভিশনকে ঋদ্ধ করবে, শুধু চাকরি নয়, নীতি, কৌশল ও দিকনির্দেশনায় ভূমিকাযোগ্য বানাবে। Geo-economics শেখা মানে শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতি ও নিরাপত্তার মধ্যে অর্থনৈতিক বলয়ের প্রভাব বোঝা। Cyber Strategy ছাড়া কোনো জাতিই এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা বা স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না। সেজন্য বিশেষভাবে-
ক. প্রতিটি উপজেলা-পৌরসভায় বাধ্যতামূলক Youth Tech-Hub & Green Lab : এই অংশটি হলো এই স্তম্ভের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো- যেখানে এই তিন স্তরের দক্ষতা অর্জন হবে বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে। Youth Tech-Hub হবে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনচর্চার কেন্দ্র এবং অও, রোবটিকস, কোডিং, ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরির প্ল্যাটফর্ম। তরুণদের জন্য সে উন্মুক্ত করে দেবে নিজেদের ঘরেই বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ।
খ. Green Lab হবে পরিবেশগত সংকট ও সমাধানের স্থানীয় চর্চাকেন্দ্র, ভূমিকা রাখবে Climate-smart agriculture, renewable energy, local ecology রক্ষায়। সে তরুণদের সবুজ সচেতনতা ও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গি গড়ে তুলতে সক্রিয় থাকবে।
গ. Defense Lab: প্রতিরক্ষা ল্যাব বলতে এমন একটি গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্রকে বোঝায়, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সামরিক কৌশল, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা নীতি বিষয়ক চিন্তা, গবেষণা, বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এটি শুধু অস্ত্র উন্নয়ন বা সামরিক গবেষণার কেন্দ্র নয়, বরং একটি কৌশলগত জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান- যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব, ভূরাজনীতি, সাইবার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত যুদ্ধপদ্ধতি বিষয়ে কাজ হয়।
এই সব প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্দেশ্য হবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেন বিশ্বমানের হয়, তা যেন শুধু উন্নয়নের হাতিয়ার না হয়। এই দক্ষতা যেন মানুষ, মাতৃভূমি, প্রকৃতি, পরিবেশ ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীল এক মানবিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ হয়ে ওঠে।