ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দেশের সবচেয়ে ছোট মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
দেশের সবচেয়ে ছোট মসজিদ

বগুড়ার সান্তাহার পৌরসভার শান্তশিষ্ট একটি গ্রাম তারাপুর। সুনিবিড় ছায়াঘেরা গ্রামটির চারদিকে শুধু সবুজের হাতছানি। নানা রকম তরুমহীরুহে ঘেরা চারপাশ। গাছের ডালে বসা হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে প্রতিটি আলোআঁধারির সন্ধ্যা। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ফসলি জমি। সবুজাভ এই গ্রামে কোনো এককালে নির্মিত হয়েছে ছোট্ট একটি মসজিদ। ভেতরে মাত্র তিনজন মানুষের নামাজ আদায় করার মতো জায়গা। এত ছোট মসজিদের ওপরে একটি গম্বুজও রয়েছে। রয়েছে একটি ধসে পড়া মিনারের ধ্বংসাবশেষ। গম্বুজটি পুরো মসজিদকে ঘিরে রেখেছে। বর্তমান অব্যবহৃত মসজিদটি অবহেলা আর অনাদৃত অবস্থায় পড়ে আছে গ্রামের এক কোণে। যেনো ভূতুড়ে কোনো বাড়ি। দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়েছে অনেক আগেই। দেয়াল ফুঁড়ে গজিয়ে উঠেছে জংলি গাছ আর লতাগুল্ম। সুনশান নীরবতা চারপাশে। দেখলেই ভয়ে গা ছমছম করে ওঠে। তাই এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে মসজিদটি।

মসজিদের উচ্চতা ১৫ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৮ ফুট। মসজিদে প্রবেশের জন্য ৪ ফুট উঁচু আর দেড় ফুট চওড়ার একটি দরোজা রয়েছে। একজন মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে ঢুকতে বা বেরোতে হতে পারে। মসজিদের দেয়ালে কোনো জানালা তৈরি করা হয়নি। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এরচেয়ে ছোট মসজিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়নি। তাই অনেকের মতে এটি কেবল বাংলাদেশেরই নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে ছোট মসজিদ।

মসজিদের দেয়াল দেড় ফুটের মতো চওড়া। এটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ভাঙা ইট আর সিমেন্ট। মসজিদের দরোজায় দুটি রাজকীয় নিদের্শনার আদলে নির্মিত খিলান রয়েছে। দেয়ালের যে অংশ এখনো টিকে আছে, সেখানে অপূর্ব কারুকার্যের ছাপ এখনও স্পষ্ট।

মসজিদের ভেতরটা বেশ চমৎকার। পরিধি ছোট হলেও ওপরের গম্বুজের দিকে তাকালে মনে হয় বড় কোনো মসজিদের গম্বুজ। সামনের দেয়ালে রয়েছে ছোট্ট একটি ধ্বংসপ্রায় মিহরাব। লতাগুল্ম আর বট গাছের শিকড় ঝুলে আছে ভেতরটায়। ফ্লোরে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে।

দেয়ালের গায়ে কোনো শিলালিপি বা ফলক না থাকায় কে বা কারা, কী কারণে মসজিদটি নির্মাণ করেছে, তা জানা যায়নি। তবে মসজিদটি ঘিরে নানা মত প্রচলিত আছে স্থানীয়দের মুখে। এই গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, আনুমানিক প্রায় ১৫০ বছর আগে তাৎকালিন গ্রাম্য শালিশে একটি পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল। সেই পরিবারের কাউকে কারো সঙ্গে ওঠাণ্ডবসা করতে দেয়া হতো না। এজন্য সেই একঘরে পরিবারের সদস্যরা নামাজের জন্য মসজিদটি নির্মাণ করে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। কেউ বলেন, সান্তাহারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে তৎকালীন রানি ভবানীর বাবার বাড়ি ছিল। এ কারণে রানি ভবানীর আসা-যাওয়া ছিল এই গ্রামে। সে সময়ে অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিল তারাপুরে। এলাকাটি তখন হিন্দু অধ্যুষিত থাকায় সেই মহিলার নামাজ পড়াতে অনেক অসুবিধা হতো। রানি ভবানী এ কথা জানতে পেরে তিনি নিজেই এই গ্রামে চলে আসেন এবং সেই মহিলার নামাজে যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য পেয়াদাদের হুকুম দিয়ে রাজকীয় নকশায় মসজিদটি তৈরি করে দেন। তবে প্রায় এলাকাবাসী জানান, তারা ছোটবেলা থেকে মসজিদটি এভাবেই দেখে আসছেন। তাই সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেন না, কে বা কারা মসজিদটি নির্মাণ করেছে।

এই ক্ষুদ্রাকৃতির মসজিদটি তারাপুর গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত। আকারে অত্যন্ত ছোট হওয়ায় উৎসুক দর্শনার্থীরা এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসেন। শত বছরের পুরোনো মন কাড়া পোড়া মাটির নকশা সম্বলিত কারুকার্য নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। শত বছরের ঐতিহ্যের এই মসজিদ বর্তমানে সংস্কারের অভাবে বিলুপ্তির পথে। মসজিদটি টিকিয়ে রাখার জন্য সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত