
ভরা মৌসুমেও লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মেঘনা নদীতে জেলেদের জালে আশানুরূপ ইলিশের দেখা মিলছে না। জেলেরা দিন-রাত চেষ্টা করেও নদীতে জাল ফেলে মাছ না পেয়ে ফিরছেন শূন্য হাতে। এতে করে মেঘনা উপকূলীয় এ উপজেলার জেলেপাড়াগুলোতে নেমে এসেছে চরম হতাশা। ইলিশ আহরণ মৌসুমের চার মাস অতিবাহিত হলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলে, আড়তদার, দাদন ব্যবসায়ী ও মৎস্যজীবী শ্রমিকরা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে দাদন শোধ ও জীবন ধারণের চিন্তায় হাতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন উপজেলার ১৫ সহস্রাধিক জেলে পরিবার।
সরেজমিন উপজেলার পাটারীরহাট, লুধুয়া, মাতাব্বরহাট, নাছিরগঞ্জ ও মতিরহাট মাছঘাট ঘুরে দেখা যায়, মৌসুমের চার মাস অতিবাহিত হলেও নদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলেসহ এরসঙ্গে জড়িত সবার জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ সময় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত সময়কে ইলিশের ভরা মৌসুম হিসেবে মনে করা হয়। এ সময় জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ার কথা। কিন্তু এ ভরা মৌসুমেও মেঘনায় ইলিশের দেখা মিলছে না। চলছে চরম আকাল। ইলিশের এ আকালে মৎস্য শিকারি জেলেসহ আড়তদার, দাদন ব্যবসায়ী ও মৎস্যজীবী শ্রমিকরা অলস দিন কাটিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যে কারণে, মাছঘাটগুলোতে ব্যবসায়ী ও জেলেদের সমাগম অনেক কমে গেছে। বড় রকমের লোকসান গুণছেন বরফকলের মালিকরাও। হোটেল-রেস্টুরেন্ট, তেল ও সুতা ব্যবসায়ীদের দোকানপাটে আমদানিও কমে গেছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
জেলেরা বলছেন, এক একটি নৌকায় তারা ১০ থেকে ১২ জন নদীতে সারাদিন জাল টেনে প্রায় শূন্য হাতে ফিরছেন। খরচের টাকার মাছও মিলছে না তাদের। নদীতে কাঙ্ক্ষিত মাছ না পেয়ে আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে পরিবারের মুখে এখন দু-মুঠো খাবার তুলে দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
মৎস্য ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা জানান, ভরা মৌসুমে মাছ না থাকায় মাছ ঘাটগুলোতে নেই হাঁকডাক। প্রতিদিন যেসব আড়তে লাখ লাখ টাকার ইলিশ বিকিকিনি হতো, সেগুলোতে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
উপজেলার মতিরহাট এলাকায় জেলে খসরু বলেন, নদীতে যে মাছ পাই তাতে আমাদেরই পেট বাঁচে না। এতে খুব কষ্টে আমাদের সংসার চলছে। একবার নদীতে যেতে তিন-চার হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ, নদী থেকে ফিরে মাছ বিক্রি করতে হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকার। এতে মহাজনের দেনাই শোধ করতে পারি না।
লুধুয়া মাছঘাটের জেলে আব্দুল মজিদ মাঝি জানান, অনেক আশা করে মহাজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দাদন নিয়ে নদীতে মাছ শিকারে যাচ্ছেন। কিন্তু এ ভরা মৌসুমেও নদীতে মাছ পড়ছে না। মহাজনের টাকা ও সাংসারিক খরচ মেটানোর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
ওই মাছঘাট এলাকার স্থানীয় মৎস্যজীবী সমিতির নেতা আবদুল ওহাব কালু মাঝি জানান, সেখানকার বেশিরভাগ জেলে দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নৌকা ও জাল গড়ে নদীতে নেমেছেন। কিন্তু সারাদিন জাল ফেলেও মাছ না পাওয়ায় তারা নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এখন অনেক জেলে নদীতে যাচ্ছে না। নদীর তীরে নৌকায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন তারা। যে কারণে, তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
উপজেলার পাটারীরহাট মাছঘাটের আড়তদার মো. মানিক বলেন, জেলেদের লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়েছি। অথচ, নদীতে মাছ না পাওয়ায় এখন আমাদের অলস সময় পার করতে হচ্ছে। এতে আমরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
তিনি বলেন, বিগত মৌসুমগুলোতে ওই ঘাটে দৈনিক গড়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মাছ কেনা-বেচা হতো। কিন্তু এখন এক লাখ টাকাও হয় না।
উপজেলার মতিরহাট মাছঘাটের সভাপতি আব্দুল খালেক জানান, নদীতে মাছ না থাকায় জেলেদের অবস্থা করুণ, আড়তদারদের অবস্থাও করুণ। আড়তদাররা এখন শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ, আগে এই সময়ে মাছঘাটে প্রতি দিন লাখ লাখ টাকার ইলিশ কেনা-বেচা হতো।
এদিকে, ভরা মৌসুমেও ইলিশের এ আকাল সম্পর্কে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, ডিমওয়ালা মা ইলিশ নিধন, ইলিশের পোনা ধ্বংস ও জাটকা নিধনসহ নদীতে ডুবোচর জেগে ওঠার কারণে ইলিশ তার গতিপথ পরিবর্তন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তবে, ডিমওয়ালা মা ইলিশ ও জাটকা নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা দবি করেন, এখন আশানুরূপ ইলিশ না পাওয়া গেলেও কিছু দিনের মধ্যেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, সমুদ্রে ইলিশ ধরা পড়লেও জলবায়ু পরিবর্তন ও নাব্য সংকটসহ বিভিন্ন কারেণ মেঘনায় জেলেদের জালে ইলিশের তেমন দেখা মিলছে না। তবে, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি বলে তিনি মন্তব্য করেন।