
ঢাক-ঢোল আর সুরের মূর্ছনা ছাড়া দুর্গাপূজা পূর্ণতা পায় না। পূজার প্রতিটি পর্বেই চাই ঢাকের গর্জন, চাই বাদ্যের আবহ। সেই প্রয়োজন মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রতিবছরের মতো এবারও বসেছে প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। এবারের হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দুই শতাধিক বাদক দল অংশ নিয়েছেন নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। গত শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলবে অজ রোববার ষষ্ঠীর গভীর রাত পর্যন্ত। গতকাল শনিবার দুপুরে হাটে গিয়ে দেখা যায়, বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে কটিয়াদী সদরের পুরান বাজার এলাকা। ঢাক-ঢোল, কাঁসি, সানাই, করতাল আর বাঁশির সুরে জমে উঠেছে পরিবেশ। প্রতিযোগিতা চলছে কে বাজাবেন সেরাটা, কার সুরে মুগ্ধ হবেন পূজা আয়োজকেরা। বাদকেরা নিজেদের দক্ষতা উজাড় করে দিচ্ছেন মণ্ডপে বাজানোর সুযোগ পেতে। অন্যদিকে পূজা আয়োজকেরা ঘুরে ঘুরে শুনছেন, পছন্দ করছেন এবং দরদাম করছেন। যার বাজনায় মন গলছে, তার সঙ্গেই হচ্ছে চুক্তি। ঘোড়াশালের পূজা আয়োজক কাজল চন্দ্র ভৌমিক জানান, তিনি প্রথমবারের মতো এ হাটে এসেছেন। পছন্দের এক ঢাকিকে ১৮ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ করেছেন। কিশোরগঞ্জ সদরের অনুকূল দেবনাথ জানান, তাদের মণ্ডপের জন্য পাঁচজনের একটি বাদক দল নিয়েছেন ৯০ হাজার টাকায়। তিনি বলেন, এবার বাদক দল কিছুটা কম এসেছে। চাহিদা বেশি থাকায় ভাড়াও কিছুটা বেড়েছে। নাম ‘ঢাকের হাট’ হলেও এখানে কোনো বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচা হয় না। এখানে আসেন কেবল বাদকেরা। তাদের বাজনা শুনে, দক্ষতা যাচাই করে পূজা আয়োজকেরা মণ্ডপে বাজানোর জন্য ভাড়া করে নেন। সম্মানির পরিমাণ নির্ভর করে দল বা সদস্যসংখ্যা, বাদ্যযন্ত্র এবং দক্ষতার ওপর।
বিক্রমপুরের ঢাকি পরিমল দাস বলেন, ফোনে অনেকে যোগাযোগ করেছিল, তবু এখানে না এলে মন মানে না। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, এটাও আনন্দের অংশ।
তিনি এবার ২০ হাজার টাকা দাবি করেছেন। দর কষাকষি চলছে। বাদক দলের সদস্য সুমন মণিঋষি জানান, তিনি গত ২০ বছর ধরে এই হাটে আসছেন। এবারে দেড় লাখ টাকা চেয়েছেন, তবে এক লাখ ২০ হাজার পেলে বাজাতে রাজি হবেন।
এই ঢাকের হাট শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নয়, ভিড় করছেন অন্যান্য ধর্মের মানুষও। তাদের কাছে এই হাট কেবল বাদ্যযন্ত্রের আয়োজন নয়, বরং এটি এখন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। এবারের হাটে অংশ নিয়েছেন বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের নানা জেলা থেকে আসা বাদক দল। ঢাক-ঢোল ছাড়াও রয়েছে বাঁশি, সানাই, করতাল, খঞ্জনি, মন্দিরা, ঝনঝনিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র।
স্থানীয়রা বলছেন, এই হাট এখন সবধর্মের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ঢাক-ঢোলের সুর শুনতে সবাই ছুটে আসেন। হাটটি এখন স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঢাকের হাটের সমন্বয়ক শীতল চন্দ্র সাহা জানান, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শ্রী মা সংঘ’ হাটের তত্ত্বাবধান করছে।
তিনি বলেন, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের সময় কটিয়াদীতে এই হাটের সূচনা হয়। পূজার জন্য সেরা ঢাকির সন্ধানে তিনি বিক্রমপুরে বার্তা পাঠান। বহু ঢাকি নৌপথে কটিয়াদীতে এসে বাজনা শোনান। রাজা নিজে সেরা দল বেছে নেন। সেই থেকেই শুরু হয় এ ঐতিহ্যের যাত্রা। হাটে আসা বাদকদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করছে আয়োজক সংগঠন।