
দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত ফসলের মাঠ এখন সোনালি আভায় ঝলমল করছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে পাকা আমন ধানের শীষ, যেন প্রকৃতি তার উদার হাতে ছড়িয়ে দিয়েছে অফুরন্ত হাসি। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলায় এ বছর আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উপজেলার কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম আর কৃষি বিভাগের সময়োপযোগী পরামর্শের সমন্বয়ে ৯ হাজার ৫৬ হেক্টর (উপজেলা কৃষি অফিসার ওয়েবসাইটের হিসাব অনুযায়ী) জমিতে ফলানো এই ধান এখন তাদের মুখে এনে দিয়েছে এক অনাবিল হাসি। মাঠের পর মাঠ কেবলই সোনালি ধানের সমারোহ, যা কেবল কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতাই নয়, স্থানীয় অর্থনীতিতেও যোগ করেছে এক নতুন উদ্দীপনা। এবারের আমন মৌসুম চান্দিনার কৃষকদের জন্য ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। রোপা আমন চাষের শুরু থেকেই কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পাশে ছিলেন। বিশেষ করে সার ব্যবস্থাপনায় এবং রোগ-পোকা দমনে তাদের পরামর্শ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। সঠিক সময়ে, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের কৌশল শেখায় কৃষকরা তাদের জমিতে সারের অপচয় রোধ করে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছেন, যা ফলন বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তা কাটিয়ে উঠেছেন কৃষকরা।
অনুকূল পরিবেশ এবং আধুনিক জাতের ধানের ব্যবহারের ফলে এবার ফলন হয়েছে আশাতীত। অনেক জমিতেই ফলনের পরিমাণ আগের মৌসুমের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ব্রি ধান-৪৯, ব্রি ধান-৫২ সহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের পাশাপাশি ব্রি ধান-১০৩ এর মতো নতুন জাতের ফলনও কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। এই ধান যেমন বেশি ফলন দেয়, তেমনি এর চাল সরু ও ঝরঝরে থাকে, যা বাজারমূল্য পেতে সহায়ক। বর্তমানে চান্দিনার বিভিন্ন গ্রামের ধানখেতগুলো এখন ফসলের ভারে নুয়ে পড়েছে। মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে ধান কাটার মহোৎসবের প্রস্তুতি। কোনো কোনো স্থানে আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে, আর তাতে উৎসবের আমেজ লেগেছে কৃষক পরিবারগুলোতে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে কৃষকদের ব্যস্ততা। কেউ ধান কাটছেন, কেউবা আঁটি বাঁধছেন, আবার কেউ সেই আঁটি মাথায় করে বা গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির আঙিনায়। ধানের শীষে লুকিয়ে থাকা হাজারও কৃষকের রঙিন স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। কৃষকরা মনে করছেন- যদি বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয় না ঘটে, তবে উৎপাদিত ধানের পরিমাণ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এতে করোনা-পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর এক নতুন প্রেরণা পাচ্ছেন তারা। ধানের ভালো ফলন এবং বাজারে দামও ভালো পাওয়ায় কৃষকদের চোখেমুখে এখন স্বস্তির রেখা। কৃষি বিভাগও সার্বক্ষণিক মাঠে নজর রাখছে, যাতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান এবং কোনো সমস্যায় না পড়েন। ধান শুধু একটি ফসল নয়, এটি আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। চান্দিনার কৃষকদের এই সাফল্য প্রমাণ করে, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে আরও বড় অর্জন সম্ভব। ফসলের মাঠের এই সোনালি হাসি কেবল চান্দিনার কৃষকদের নয়, এটি পুরো দেশের জন্য এক শুভ বার্তা। এখন অপেক্ষা কেবল নবান্ন উৎসবের, যখন প্রতিটি বাড়িতে নতুন ধানের গন্ধে ভরে উঠবে চারপাশ, আর সেই সুঘ্রাণই বলে দেবে, কঠোর পরিশ্রম আর প্রকৃতির আশীর্বাদে চান্দিনার কৃষকরা এবার বিজয়ী।