মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে মুমিনরা তোমাদের ওপর রমজান মাসের রোজাকে ফরজ করা হলো, যেভাবে তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপরও ফরজ করা হয়েছিল’। ইসলাম ধর্মের উপর ইমান আনার পর যেভাবে ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত নরনারীদের ওপর নামাজ ফরজ বা বাধ্যতামূলক করতেই হবে, ঠিক সেভাবে রমজান মাসের রোজাকে আদায় করতে হয়। মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনে আরও বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ এই রমজান মাসে উপস্থিত থাকে সে যেন রোজা রাখে।’
মহান আল্লাহর বাণীতে যেভাবে রোজার কথা নির্দেশ করা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে রোজাকে ছেড়ে দেয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে, সে যেন মহান আল্লাহপাকের নির্দেশকে অমান্য করল আর একথাও অবগত হওয়া দরকার, রোজা ত্যাগকারীদের মুসলমানিত্ব ছুটে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা থাকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আরবি এই রমজান মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ। এই মাসের ফজিলত বা মঙ্গল সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস রয়েছে।
রমজান আরবি শব্দ। রমজান শব্দটি রমজ ধাতু থেকে নির্গত হয়েছে। এর অর্থ জ্বালিয়ে দেয়া। কাঠখড়িতে আগুন যেভাবে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়, ছিক সেভাবে রোজা বান্দার পাপকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। অন্য অর্থে বোঝা যায় যে, ময়লাকে ধৌত করলে যে রকম পরিষ্কার হয়, ঠিক সেরকম পাপ পরিষ্কারভাবে মাফ হয়ে যায়। এই সিয়াম সাধনার মাস মুসলমানের জন্য বেহেস্তি হওয়ার অন্যতম সময়োপযোগী সুযোগ। একটা শিশু মায়ের গর্ভ থেকে যেভাবে নিষ্পাপ হিসেবে বের হয়, ঠিক সেভাবে এ মাসে রোজা রেখে আল্লাহকে রাজি করতে পারলে নবগত শিশুর মতো নিষ্পাপ হওয়া যায়। তবে রোজাধারের উচিত, রোজা অবস্থায় যাতে কোনও নিয়ম ভঙ্গ না হয়। রোজা সংক্রান্তবিষয় সম্পর্কে রোজাদারদের জ্ঞান ও অবগতি একান্ত কর্তব্য। নতুবা সারাদিন উপবাস থেকে কোনও লাভবান হওয়া যাবে না, বরং বড় ধরনের ক্ষতি ও পাপ হবে। সারাদিন রোজা ধরে যদি পাপী হই, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে। তাই রোজা রাখতে গিয়ে কয়েকটি নিয়মের দিকে খেয়াল রাখতে হবে- ১) কুদৃষ্টি, পরনারীর প্রতি কামদৃষ্টি নিক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা, ২) মিথ্যা কথা বলা, ৩) চুুকলিখোর, ৪) মিথ্যা শপথ খাওয়া, ৫) গিবত করা, ৬) কুকর্ম হতে প্রত্যেক অঙ্গকে দূরে রাখা, ৭) অশ্লীল বাক্য মুখে না আনা, ৮) কুপ্রথা-কুকর্ম থেকে বিরত থাকা, ৯) কুচিন্তা থেকে মনকে দূরে রাখা, ১০) হালাল রুজি ভক্ষণ করা ও ১১) রোজা কবুল হচ্ছে কি না, আল্লাহর ভয়ে চিন্তা করতে হবে। আর বিশেষ করে রোজাদারদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, যাতে কোনো ধরনের শরিয়তবিরোধী কাজ নিজে থেকে যেন না হয়।
রমজানে রোজাকে সঠিক নিয়মে পালন করতে পারলে মহান আল্লাহ আমাদের অসংখ্য সওয়াব ও পুরষ্কার দেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর (সা.) বলেছেন- ‘আমার উম্মতকে পাঁচটি বস্তু দেওয়া হয়েছে যা পূর্ববতী উম্মতকে দেওয়া হয়নি।’
বস্তুগুলো হলো- ১) রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে মৃগনাভির চেয়ে খুশবদার ও পছন্দনীয়। ২) সমুদ্রের মৎস্য পর্যন্ত রোজাদারের জন্য দোয়া করতে থাকে ইফতার পর্যন্ত। ৩) প্রতিদিন জান্নাতকে রোজাদারের জন্য সুসজ্জিত করা হয়, আর মহান আল্লাহ পাকের ঘোষণা হয়, অতি শিগগিরই আমার নেক বান্দারা দুনিয়ার কষ্ট থেকে মুক্তিলাভ করে আমার কাছে আসছে। ৪) রমজান মাসে দুর্বৃত্ত শয়তানকে কয়েদ বা শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, যার দরুন সে এসব পাপ করাতে পারে না, অন্য মাসে যেসব পাপ করানো সম্ভব। ৫) রমজানের শেষ রাতে মহান আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদের গোনাহ মাফ করে দেন। পূর্বেই বলেছি, এই মাসের গুরুত্ব অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি। এই মাসে মহান আসমানি প্রায় সব কেতাব নাজেল করেছেন। এ মাসে ইসলামের সংবিধান কোরআনও নাজেল হয়েছে।
এই মাসের তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য দেখে যুগ যুগ ধরে নবী ও সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী যুগের অলি-আউলিয়া, শরিয়তপন্থির বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ, জিকির, নামাজ, জাকাত, সদকাহ ইত্যাদি উপযুক্ত কাজ করেছেন ও করার নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে ইসলাম বিশ্বাসী শরিয়তপন্থিরা এই মাসে কম-বেশি এবাদত বন্দেগি করেন। রমজানেও যারা মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারল না বা গোনাহ থেকে মাফ হলো না তার সম্পর্কে হাদিসের ভাস্য মতে, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান ছেলেমেয়ে পিতামাতাকে জীবদ্দশায় পেয়েছে অথচ পিতামাতার দোয়া নিয়ে বেহেস্তি হতে পারল না, তার মত বুরবক আর দুনিয়াতে নেই।’ যে মুসলমান জীবদ্দশায় রমজান মাস পেয়েছে এবং রমজানের দ্বারা বেহেস্তি হতে পারল না তার মতো বুরবক আর নেই। তাছাড়া রমজান মাসে কম এবাদতের বিনিময়ে বেশি বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, রমজান মাসে একবার তসবিহ পাঠ করার সওয়াব অন্যান্য মাসের এক হাজারবার তসবিহ পড়ার সমান।
‘একদা নবী (সা.) হজরত সাফিয়া (রা.)-কে চার হাজার খেজুরের বীজ একত্রিত করতে দেখলেন। তখন নবী (সা.) তাকে বললেন, কী জন্য এই বীজগুলো একত্রিত করছ? উত্তরে বললেন, তসবিহ পাঠ করার জন্য। তখন নবী সাফিয়াকে একটি তসবিহ শিখিয়ে দিয়ে বলেন, এই তসবিহ যদি রমজান মাসে পাঠ কর তাহলে সওয়াব দাঁড়াবে ৪০ লাখ।’
এছাড়া এই কোরআন তেলাওয়াত করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। একটি হাদিসে আছে, ‘প্রত্যেক রমজান মাসে হজরত জিব্রাইল (আ.) নবীকে পূর্ণ কোরআন শরিফ শোনাতেন।’ আবার আরেক হাদিসে আছে, ‘নবী নিজে শোনাতেন আর জিব্রাইল (আ.) শুনতেন।’ এই মাহাত্ম্যপূর্ণ মাসে ইমাম বোখারি (রহ.) একষট্টিবার কোরআন শরিফ খতম করতেন। ইমাম আবু হানিফা (র.) ৬০ বা ৬১ বার কোরআন খতম করতেন রমজান মাসে। মওলানা আব্দুর রহিম (র.) এই মাসে দিন রাত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এমনকী চিঠিপত্রও পাঠ করতেন না, তার উত্তর দিতেন না, লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা ভালো পেতেন না। রমজানে কোরআন তেলাওয়াত করা ও শোনা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা বুঝেও বুঝতে পারছি না।
পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী হজরত মওলানা হুসাইন আহমদ মদনি (র.) সমস্ত দিন-রাত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বিভিন্ন জেলখানায় রমজান মাসে একেক রাতে ১৪ থেকে ১৫ পারা কোরআন শরিফ পাঠ করতেন। মাল্টার জেলে চার বছর তার শিক্ষক শেয়খুল হিন্দের সঙ্গে রমজান মাস পেয়েছেন। ইংরেজ জেলে বারবার আক্রমণ চালালেও তারা এবাদত বন্ধ করেননি।
তাই আমাদের উচিত, এই মাসে বেশি এবাদত পবিত্র শাবানের এবাদত বন্দেগি করা। রমজানের তসবিহ নামাজ খতমে কোরআনে আদায় অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। তাছাড়া এই মাসের শেষ দশদিন এতেকাফ করা পুণ্যের কাজ। নবী করিম (সা.) নিজে করেছেন ও করার নির্দেশও দিয়েছেন। আরেক কথা মনে রাখা দরকার, এক এক মহল্লা থেকে প্রত্যেকের, কমপক্ষে একজন মসজিদে এতেকাফ করা জরুরি, নতুবা সমস্ত মহল্লার লোক গোনাহগার হবেন। এছাড়া মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাতও রয়েছে, যেটাকে বলা হয় ‘শবেকদর’। শবেকদর সম্পর্কে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, এটা এক হাজার মাস অর্থাৎ ত্রিশ হাজার রাত্রি থেকেও উত্তম। হাদিস শরিফের মতে, রমজানের শেষ দশ রাতের মধ্যে বেজোড় যে কোনো এক রাতেই শবেকদর হয়।
নবী (দ.) শবেকদর অন্বেষণের জন্য প্রথম দশ দিন, মধ্যের দশ দিন আর শেষের দশ রাত্রির মধ্যে শবেকদর নিহিত বলে উল্লেখ করেছেন। নবী (দ.) কখনও এতেকাফ ত্যাগ করেননি। তাই আমাদেরও উচিত নবী (দ.)-এর মতো এতেকাফ করা।
রমজান মাসের তাৎপর্য, মাহাত্ম্য ও ফায়দা সম্পর্কে লিখে শেষ করা সম্ভব না। তবে রোজার বিজ্ঞাপনের সামান্য মিল সম্পর্কে উল্লেখ করছি। ডাক্তার ক্লাইড মেকক মানবজীবন দীর্ঘায়ু করার একটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।
তত্ত্বটি নতুন একথা বলা যাবে না। কারণ, ইসলামি শরিয়তে-এর সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। তত্ত্বটি হলো প্রাণী দেহে যতদিন বাড়তে থাকে ততদিন বার্ধক্য আসতে পারে না। শরীরের বাধা থেমে গেলেই ক্ষয় আরম্ভ হয়ে বার্ধক্য আসে। এর জন্য বার্ধক্যের সূচনা থামিয়ে রাখতে হলে শরীরের বৃদ্ধি যাতে ধীরগতিতে চলে তার ব্যবস্থা করা দরকার। কচ্ছপ দীর্ঘজীবী।
এরা ১০০ বছর বাঁচতে পারে। কারণ, কচ্ছপের দেহ দীর্ঘকাল ধরে মন্থরগতিতে বাড়তে থাকে। মানুষের মতো ২৫ বছরে তাদের দৈহিক বৃদ্ধি শেষ হয় না। উপবাস ব্যতীত শরীরের বৃদ্ধিকে ধীরগতিতে সম্পন্ন করার কোনও ব্যবস্থা নেই। ডা. মেকক ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করে এর সত্যতা বের করেছেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘ জীবন লাভ করার জন্য খাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। প্রবাদ বলে- ‘বেশি বাঁচবি তো কম খা।’
বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিকিৎসব ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেছেন, যারা আজীবন নিয়মিতভাবে রোজা পালন করে, সাধারণত তারা বাত, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় না। তিনি আরও বলেন, সপ্তাহে একদিন রোজা পালন করা বহুমূত্র রোগীর পক্ষে উপকারী। রোজার উপবাসে খাদ্যের সমতা রক্ষা হয় ও পাকস্থলি কিছুকালের জন্য বিরাম লাভ করে, রোজাদারদের অজীর্ণ না হওয়ার এটাই কারণ। এছাড়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজা মানুষের জন্য উপকারী। সবাই যেন রমজান মাসকে কাজে লাগাতে পারি, যদি রমজান মাসকে আমরা হাতছাড়া করি, অধঃপতন ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।