ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে হুমকিতে পরিবেশ

অলোক আচার্য
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে হুমকিতে পরিবেশ

বিশ্বজুড়েই পরিবেশ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেই মাত্রা এমন যে এখনই পদক্ষেপ না নিলে মানবসভ্যতাই হুমকিতে পড়বে। উন্নয়নের নামে সারা বিশ্বেই পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞ চলে বছরব্যাপী। উন্নয়নের প্রথম বলি হয় গাছ। অথচ এসব গাছেরও জীবন আছে। তাদেরও কষ্ট হয়। মরে যাওয়ার অনুভূতি আছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু এ কথা বহু আগেই প্রমাণ করেছেন। গাছ কেটে আমরা অথবা এই শিল্পনির্ভর বিশ্ব যে মহাভুল করছে সেকথা স্বীকার করলেও সেখান থেকে বাঁচার পথ না খুঁজে ফের গাছ কাটাতেই ব্যস্ত আছে। যার ফল পাচ্ছি হাতেনাতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতির এই আচরণের পেছনে রয়েছে পরিবেশ দূষণের ভূমিকা। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যে কোনো এক বছরের বার্ষিক তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ডকে ভাঙবে। এমন সম্ভাবনা রয়েছে অন্তত ৮০ শতাংশ। চরম আকারের খরা, বন্যা ও বনাঞ্চলে আগুনের পরিমাণ বাড়ায় এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা সবচেয়ে বেড়েছিল প্রাক-শিল্প যুগে। তবে ওই সময়ের থেকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো এক বছরে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হবে বলে ডব্লিউএমও এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ২০৩০ সালের আগেই এমন পরিস্থিতি দেখতে হবে বিশ্ববাসীকে। আর সংস্থাটির এ প্রতিবেদনের ভবিষ্যতদ্বাণীকে ‘শকিং’ বলে আখ্যা দিয়েছে বিজ্ঞানীরা। সংস্থাটি বলছে, ২০২৫-২৯ বছরের গড় তাপমাত্রা প্রাক শিল্প-যুগের থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকবে। এমন সম্ভাবনা রয়েছে ৭০ শতাংশ। ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বার্ষিক তাপমাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) তথ্যমতে, ১৮৫০ সালের পর গত বছর ছিল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। ২০১৪ সালে তাপমাত্রার পরিমাণ এত বাড়াকে অকল্পনীয় বলে আখ্যা করা হয়েছিল। ২০৩০ নাগাদ তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বাড়তে পারে এমন সম্ভাবনা আগে ছিল এক-শতাংশ। এমনকি, পাঁচ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বাড়াকে অসম্ভব বলা হত। তবে এল নিনো ও ব্যাপকহারে আর্কটিকের বরফ গলা ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে সম্ভব করে ফেলছে।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বহুমুখী। অর্থাৎ জলবায়ুর কারণে আমাদের ক্ষতির বোঝা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জিওগ্রাফির একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ। নেচার সাসটেনেবিলিটি পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবল উষ্ণায়ন ও স্থলভাগে পানির সংকট- এ দুই কারণে পৃথিবীজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দশগুণ বাড়বে। কার্বন নিঃসরণও সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে। এসব কারণে অর্থনীতিও প্রবাভিত হবে। ধনীরা আরও ধনী হবে এবং গরিব আরও গরিব হবে।

খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে এ পরিস্থিতি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, খরাবিধ্বস্ত হর্ন অব আফ্রিকায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২২ মিলিয়ন পৌঁছেছে। কেনিয়া, সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখে পড়েছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনবিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি। যা দৈনিক গড়ে দুইটির কাছাকাছি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী। এটি আগের তিন দশকের গড় দুর্যোগের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ।

শিল্প যুগ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর আবহমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ধ্বংস হওয়ার সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। এর দুইটি কারণই মানবসৃষ্ট। একটি হলো যুদ্ধ এবং অপরটি হলো- প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ দূষণ শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সিসা বিষক্রিয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করছে। এর ফলে বছরে প্রাক্কলিত আইকিউ ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ মিলিয়ন পয়েন্ট। গৃহস্থালিতে কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে রান্না বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস এবং তা নারী ও শিশুদের বেশি ক্ষতি করছে। শিল্পের বর্জ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা অপরিশোধিত ময়লাযুক্ত পানির কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির গুণগতমানের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সময়মতো এবং জরুরি হস্তক্ষেপ, উন্নত পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) এবং সিসা দূষণ প্রতিরোধ করা গেলে বছর ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি অকাল মৃত্যু ঠেকাতে পারে। সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ, রান্নায় সবুজ জ্বালানির ব্যবহার এবং শিল্পকারখানা থেকে দূষণ রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বায়ুদূষণ কমাতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষা জোরদারে পদক্ষেপ এবং রান্নায় সবুজ জ্বালানির জন্য বিনিয়োগ ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিদূষণ কমাতে পারে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এমনকি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ঘটছে, মানুষের সম্পদের বিনষ্ট ঘটছে, স্থানচুতি ঘটছে এবং জীবিকার পরিবর্তনের মানুষের জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব পরছে। বজ্রপাতের মৌসুমেও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেই তীব্র গরম আবহাওয়া বদলানো ইঙ্গিত দিচ্ছে। কয়েকদিন আগেই রোমেল আঘাত করেছে। এভাবে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ শেষ হতে না হতেই আর একটি দুর্যোগ আঘাত করছে। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও যে ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটাও কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাব। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম; কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা।

যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের উপর। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখি, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শহরের উপর চাপ বাড়ছে। ভিক্ষাবৃত্তি বাড়ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছি আমরা। যদি তা হয় তাহলে আমাদের দেশের একটা অংশ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু আমাদের দেশ নয়। এরকম নিচু বহুদেশ সমুদ্রগর্ভে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে আমাদের প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। আর প্রকৃতি বাঁচাতে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে।

যে বিপুল সংখ্যক গাছ প্রতিদিন আমাদের প্রকৃতি থেকে কাটা হচ্ছে তার চেয়ে খুবই কম সংখ্যক গাছ লাগানো হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে যে, সবুজায়ন ছাড়া মানব জাতির এ থেকে মুক্তি নেই; কিন্তু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে সংকটই বয়ে আনতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মানুষ হবে সবেচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে অস্ত্র প্রতিযোগিতার পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ না করে পরিবেশ রক্ষায় এর কিছু অংশ বিনিয়োগ করলে বেশি লাভবান হওয়া যেত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত