ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সংবাদপত্রের সোনালি দিন স্মৃতির জৌলুস ও বর্তমান সংকট

সেলিম রানা
সংবাদপত্রের সোনালি দিন স্মৃতির জৌলুস ও বর্তমান সংকট

শীত কিংবা বর্ষা কাকডাকা ভোরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত মানুষ, কখন সংবাদপত্র আসবে, কখন সে তার কাঙ্ক্ষিত খবর, প্রিয় লেখকের কলাম কিংবা নতুন কোনো চিত্র প্রতিবেদন পড়বে। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ছাপা হতো নতুন দিনের প্রত্যাশা, সঙ্গে থাকত কালি ও কাগজের গন্ধ। এক কাপ চা আর পত্রিকার সঙ্গে দিন শুরু করার অভ্যেস যেন একরকম পারিবারিক সংস্কৃতিতেই পরিণত হয়েছিল। ঘরের সব সদস্যদের জন্য কাগজের প্রতিটি পাতার ছিল আলাদা আলাদা আবেদন ও কৌতূহল। বাড়ির কর্তা ব্যক্তি দেশ-বিদেশের হালচাল জানতে খুঁটিয়ে পড়তেন প্রথম পৃষ্ঠা ও সম্পাদকীয়। গৃহিণী রাধুনি ও বাজারের হালচাল সম্পর্কে আপডেট থাকতেন ‘নারী ও পরিবার’ পাতায়। বাড়ির মেয়ে বা ছেলের স্ত্রী রূপচর্চা, স্বাস্থ্য ও রান্নাবান্নাবিষয়ক পাতায় ডুবে থাকতেন। আন্তর্জাতিক ও অর্থনীতির পাতা চলে যেত বড় ছেলের দখলে, আর ছোটরা মেতে থাকত খেলাধুলা, শিক্ষা ও সাধারণ জ্ঞানের কুইজ পাতায়। বেকার তরুণরা চাকরির বিজ্ঞাপন কেটে রেখে দিন গুনতেন একটি সরকারি চাকরির স্বপ্নে। সংবাদপত্রের ছিল সত্যিকারের এক আনন্দময় ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি, যা কখনও ভুল তথ্যের আশ্রয় নিত না। একে বিশ্বাস করা যেত চোখ বন্ধ করে। কিন্তু সময় বদলেছে। এখনকার আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বন্যায় সত্য-মিথ্যার কোনো বাছবিচার নেই। নিয়মণ্ডনীতিহীন, যাচাইবিহীন তথ্য ছড়াচ্ছে মুহূর্তেই এবং সাধারণ মানুষ না বুঝেই সেগুলো বিশ্বাস করে নিচ্ছে। একসময় যারা সকালে পত্রিকার অপেক্ষায় থাকত, তারা এখন রাতভর স্ক্রল করে অগণন ‘ফেইক নিউজ’ গ্রহণ করছে। অথচ সংবাদপত্র তার নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও পাঠক হারাচ্ছে আস্থা, আর অর্থনৈতিক চাপের মুখে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময় এবং সংগ্রামের সাক্ষ্যবাহী। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংবাদপত্র হয়ে ওঠে সমাজের দর্পণ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তো সংবাদপত্র ছিল এক অনন্য অস্ত্র দেশের মানুষকে জাগিয়ে তোলার, মনোবল চাঙা রাখার ও তথ্যের আলোর মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপায়। স্বাধীনতার পরেও এটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। কিন্তু আজ? আজ সংবাদপত্রের গৌরব যেন প্রযুক্তির দাপটে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একদিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সহজলভ্যতা ও ‘তাৎক্ষণিক’ সংস্কৃতি, অন্যদিকে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার সংকট, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং বিজ্ঞাপন ও পাঠক সংকট সব মিলিয়ে সংবাদপত্র আজ এক বহুমাত্রিক চাপে জর্জরিত। বিশ্বজুড়ে প্রিন্ট মিডিয়ার সংকট বাস্তব এবং দ্রুতগতিতে দৃশ্যমান। তবে এটিকে শুধু ক্ষয় হিসেবে দেখলে চলবে না। বরং এটি হতে পারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের সুযোগ। সংবাদপত্রের উচিত এখনই আত্মসমালোচনা, কাঠামোগত সংস্কার, পাঠকবান্ধব কনটেন্ট তৈরি এবং অনলাইন ও প্রিন্ট উভয় মাধ্যমকে একীভূত করে নবতর মডেল তৈরি করা। ডিজিটাল যুগের আগমন সংবাদপত্রের উপর সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্রের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলা একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী টেলিভিশন ছিল, কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্মগুলো এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। প্রযুক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং ট্যাবলেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে খবর পেতে পারেন, যা সংবাদপত্রের তুলনায় অনেক দ্রুত এবং সহজ। বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তার এবং সেগুলোর মাধ্যমে খবর ছড়ানো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে।

ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে খবর প্রচার এবং শেয়ার করা অনেক সহজ হয়েছে। মানুষ এখন আর সংবাদপত্রের জন্য অপেক্ষা করে না। তারা খবরের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মতামতও প্রকাশ করে, যা সংবাদপত্রের কনটেন্টের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। সংবাদপত্রের অর্থনৈতিক মডেলটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞাপন আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেওয়ার খরচ কম হওয়া এবং ইন্টারনেটভিত্তিক বিজ্ঞাপনের সহজলভ্যতা সংবাদপত্রের আয়ের বিপরীতে এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতারা আরও সস্তায় এবং নির্দিষ্ট শ্রোতাদের লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, যা সংবাদপত্রের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। ফলে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয় কমে গেছে এবং তাদের আয়ের মডেল ভেঙে পড়েছে। এই আর্থিক সংকটের কারণে সংবাদপত্রগুলো কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দেয়, সম্পাদকীয় মান হ্রাস পায় এবং নতুন সাংবাদিকদের নিয়োগে তাদের সক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া, সামগ্রিকভাবে পত্রিকার প্রকাশনা এবং প্রশাসনিক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে সংবাদপত্রের পরিচালনা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত