ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সমাজ ও অর্থনীতির শত্রু : অনলাইন জুয়া

মোসা. মিশকাতুল ইসলাম মুমু
সমাজ ও অর্থনীতির শত্রু : অনলাইন জুয়া

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা যেমন অনেক সুবিধা লাভ করছি, তেমনি কিছু সমস্যাও আমাদের সমাজে গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো অনলাইন জুয়া। একসময় জুয়া ছিল নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সীমাবদ্ধ- ক্যাসিনো, তাসের আড্ডা বা হাট-বাজারে কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ খেলা। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগের সহজলভ্যতার কারণে ঘরে বসেই অনলাইনে জুয়া খেলা সম্ভব হচ্ছে এবং সেটাই হয়ে উঠছে হাজার হাজার পরিবারের ধ্বংসের কারণ।

বর্তমানে অনলাইন জুয়া একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর মূল আকর্ষণ হচ্ছে- ‘সহজে অর্থ উপার্জনের সুযোগ’। অনেকেই ভাবে, ‘মাত্র দুইটা বাজি খেলি, কপাল ভালো থাকলে কয়েক হাজার টাকা পেয়ে যাব!’ এই চিন্তাভাবনা থেকেই শুরু হয় এক বিপজ্জনক যাত্রা। প্রথমবার জিতে গেলে লোভ আরও বেড়ে যায়, আর হারলে মনে হয় পরেরবার জিতেই আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। এই চক্রেই একজন মানুষ ধীরে ধীরে ডুবে যায় গভীর জুয়ার নেশায়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোও অত্যন্ত কৌশলীভাবে এই নেশায় মানুষকে আসক্ত করে তোলে। নানা ধরনের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, ‘ফ্রি বেট’, ‘সাইন-আপ বোনাস’ এবং ‘ক্যাশব্যাক অফার’ ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের বারবার ফিরে আসতে বাধ্য করে। বর্তমানে লুডু, পোকার, রুলেট এমনকি আইপিএল, বিপিএল কিংবা সাধারণ ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের ফলাফল নিয়ে বাজি ধরার সংস্কৃতিও বেড়ে গেছে। এসব খেলা এমনভাবে ডিজাইন করা থাকে যাতে ব্যবহারকারী বুঝতেই না পারে কখন সে অল্প অল্প করে অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছে।

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, দেশে শতাধিক অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ জুয়া খেলেন। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে এই বাজার চার দশমিক সাত শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। ফলে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছেন লাখ লাখ তরুণ-তরুণী, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জুয়ার জন্য ব্যবহৃত সাইট ও অ্যাপগুলোতে সহজেই ইমেইল, মোবাইল নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, যেখানে একটি ভার্চুয়াল ওয়ালেট যুক্ত থাকে। এই ওয়ালেটে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে অবৈধভাবে টাকা কনভার্ট করে ‘বট ব্যালেন্স’ হিসেবে যোগ করা হয়, যা সরাসরি জুয়া খেলায় ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আলোচিত কয়েকটি অনলাইন জুয়ার অ্যাপ হলো- ওয়ান এক্স বেট, বেট থ্রি সিক্সটি ফাইভ, মোস্ট বেট, প্যারিম্যাচ ইত্যাদি। এসব জুয়ার প্ল্যাটফর্ম সাধারণত ফেসবুক পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট এবং এনক্রিপ্টেড মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব সাইটের বেশিরভাগই পরিচালিত হয় রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে, যেখানে বাংলাদেশি এজেন্টরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক বেটিং সাইটগুলোর সহজ প্রবেশাধিকারের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ- বিশেষ করে তরুণরা এই মরণফাঁদে পা দিচ্ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথমে মজার ছলে অল্প টাকা বিনিয়োগ করে জুয়া খেলা শুরু করলেও ধীরে ধীরে এই আসক্তি তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। হারানো টাকা পুনরুদ্ধারের জন্য তারা ধারদেনা করে, পরিবারের টাকা চুরি করে, এমনকি অনেক সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পরিবার ও সমাজের ওপরও এই আসক্তির ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।

তরুণদের ওপর অনলাইন জুয়ার প্রভাব ভয়াবহ। বহু শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে জুয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একবার এই নেশায় জড়িয়ে পড়লে তাদের পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয়, তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। হারানো টাকা ফিরে পাওয়ার মানসিক চাপ তাদের উদ্বেগ ও হতাশার দিকে ঠেলে দেয়, যা অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয়। শুধু শিক্ষার্থী বা তরুণরাই নয়, কর্মজীবী অনেক মানুষও এই আসক্তির শিকার হচ্ছে। অনেকে বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে দ্রুত ধনী হওয়ার লোভে জুয়া খেলতে শুরু করে। কেউ কেউ মাসের বেতনের পুরো টাকাই জুয়ায় বিনিয়োগ করে দেন, ফলে মাস শেষে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনলাইন জুয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়েছে, সংসার ভেঙে গেছে, সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুধু তাই না, অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন সেলিব্রিটি, তারকা ও অভিনেত্রী-অভিনেতারাও অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তারা অর্থের লোভে পড়ে এসব সাইটের বিজ্ঞাপন বা প্রচার চালায়।

এই অনলাইন জুয়ার আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং অর্থ পাচার। অনলাইন জুয়ার অধিকাংশ প্ল্যাটফর্মই বিদেশি, ফলে এই খাতে যে বিশাল অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়, তার বড় অংশ দেশ থেকে বেরিয়ে যায়। অনলাইন জুয়ায় এ দেশ থেকে বছরে পাচার হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং বিভিন্ন গোপন লেনদেনের মাধ্যমে টাকার লেনদেন হওয়ায় এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জুয়ার নামে প্রতারণাও করা হয়। কিছু প্ল্যাটফর্ম প্রথমে ব্যবহারকারীদের টাকা জিততে দেয়, পরে যখন তারা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে, তখন বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে সব টাকা হাতিয়ে নেয়। ফলে জুয়াড়িরা দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও এটি ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনছে। অনলাইন জুয়া এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে, যা মাদকের মতোই ক্ষতিকর। একবার এই নেশায় আসক্ত হলে ব্যক্তি সহজে বের হতে পারেন না। হারানো টাকা ফিরে পাওয়ার মানসিক চাপে উদ্বেগ, হতাশা ও বিষণ্ণতা তৈরি হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, যা সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই ভয়াবহতা রোধ করার এখনই সময়।

বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এ আইন ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং বর্তমানে এটি বেশ পুরোনো ও দুর্বল। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, জুয়ার আসর পরিচালনা বা অংশগ্রহণের জন্য সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা নির্ধারিত। এই আইন শুধুমাত্র প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অনলাইন বা ডিজিটাল জুয়ার কোনো উল্লেখ নেই। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় আইনটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাই ১৫৮ বছরের এ পুরোনো আইন সংশোধন করে একে যুগোপযোগী করা উচিত।

অনলাইন জুয়া বন্ধে বিটিআরসি ও সাইবার পুলিশ জুয়ার কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করলেও ভিপিএন ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সাইটগুলোতে সহজেই প্রবেশ করা যায়। অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপ বন্ধে কার্যকর আইনি উদ্যোগের অভাব রয়েছে। ফলে শুধু আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, বরং এর কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ভিপিএন ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে যারা এই নিষিদ্ধ সাইটে প্রবেশ করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অনলাইন জুয়া বন্ধে পরিবারের ভূমিকাও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নজর রাখা, তাদের অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকা। তাদের সময় কাটানোর প্যাটার্ন পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও সচেতন থাকতে হবে।

শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে যেন তারা এ ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত না হয়। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন নিরাপত্তা ও জুয়ার কুফল সম্পর্কে সচেতনতামূলক সেশন আয়োজন করা যেতে পারে। সাধারণ জনগণের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সেলিব্রিটি, তারকা ও জনপ্রিয় ব্যক্তিরা যদি এ নিয়ে সচেতনতামূলক বার্তা দেন, তা হলে তরুণ প্রজন্মের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকারের উচিত মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়ানো, যাতে অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মে অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও ভিডিও প্ল্যাটফর্মে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা উচিত এবং প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন সময়ে দেখে যায়, অনেক সেলিব্রিটিরাও অনলাইন জুয়ার প্রচার চালায়। তাই এদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

অনলাইন জুয়া কেবল একটি নেশা নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুধু সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে দিলে চলবে না, পরিবার, সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, যদি এখনই আমরা সতর্ক না হই, তবে সামনে আরও হাজার হাজার পরিবার ধ্বংসের মুখে পড়বে। অনলাইন জুয়া থেকে মুক্ত সমাজ গড়তে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে—তাই সময় থাকতেই সাবধান হওয়া জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত