প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
খাদ্য শুধু মানুষের মৌলিক চাহিদা নয়- একটি দেশের স্থিতি, অগ্রগতি ও নিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্য আর শুধুই কৃষি বা উৎপাদনের বিষয় নেই; এটি এখন বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যে বিশ্বের ওপর আমরা খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে নির্ভর করি, সেই বিশ্বই আজ অস্থিরতার ঘূর্ণাবর্তে। কখনও যুদ্ধ, কখনও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, কখনও জলবায়ু বিপর্যয়- সব মিলিয়ে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলা ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। এই বৈশ্বিক উদ্বেগের ছায়া সবচেয়ে বেশি পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর, যার একটি বাংলাদেশ।
একদিকে আমাদের অর্জন আছে- অন্যদিকে আছে বহুমাত্রিক ঝুঁকি। ঠিক এই সংকটময় সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের অবস্থান নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বের অন্যতম শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত ওই অঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের রপ্তানিকারক দেশ।
যুদ্ধের প্রভাবে ফসল উৎপাদন কমেছে, কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কৃষিপণ্য পরিবহনের সমুদ্রপথ বারবার বন্ধ হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা খাদ্য ও সার বাজারে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় রপ্তানি সীমিত করছে। ভারতীয় চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ তার বড় উদাহরণ। এর ফলে খাদ্যনির্ভর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনও চাল, গম, ভোজ্যতেলসহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্যে আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল হলে দেশের বাজারেও তার প্রভাব দ্রুত পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনও বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এসব কারণে উপকূলীয় ও উত্তরাঞ্চলের ফসল উৎপাদন সংকটে পড়ে। তাছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন মৌসুম অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
এছাড়া খাদ্য সংরক্ষণের পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় উৎপাদিত খাদ্যের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, অদক্ষ বিতরণব্যবস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণহীন সক্রিয়তা খাদ্যের প্রকৃত মূল্য ও সরবরাহে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের প্রধান ঝুঁকিগুলো হলো-
উচ্চ আমদানিনির্ভরতা : আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হলে সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের খাদ্যমূল্যে।
জলবায়ু সংকট : উপকূল, চর, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা : উন্নত সাইলো ও শীতলঘর কম হওয়ায় খাদ্য অপচয় বাড়ে।
সারের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিরতা : উৎপাদন কমে যেতে পারে।
ডলারের দাম বৃদ্ধি : খাদ্য আমদানির ব্যয় বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক টানাপড়েন : হঠাৎ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বা যুদ্ধ পরিস্থিতি খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করে।
এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাব্য পথ খুঁজে বের করতে হলে-
বহুমুখী খাদ্য উৎস ও স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো : গম, ডাল, তেলবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।
আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার : খরা সহনশীল ও লবণাক্ত সহনশীল ধানের জাত সম্প্রসারণ জরুরি।
কৌশলগত খাদ্য মজুত বৃদ্ধি : সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি গুদাম ও সাইলো নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
অর্থনৈতিক কূটনীতি : প্রধান খাদ্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি করা প্রয়োজন।
বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা : মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
চ্যালেঞ্জ আছে, কিন্তু সম্ভাবনাও কম নয়। সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর নীতি ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে পারলে খাদ্য সংকটের ঝুঁকি মোকাবিলা করা শুধু সম্ভবই নয়- বাংলাদেশ ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তায় আরও আত্মনির্ভর, আরও স্থিতিশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। দেশকে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে নিতে হবে- সচেতনতা, প্রস্তুতি এবং দূরদর্শিতার সমন্বয়ে।
জান্নাতুল ফেরদাউস অহনা
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়