ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শিক্ষার স্বপ্ন নাকি স্বপ্নের শিক্ষা

কামরুন নাহার সাথী
শিক্ষার স্বপ্ন নাকি স্বপ্নের শিক্ষা

শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে এরইমধ্যে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়ে গেছে। তা হবেই, পরিবর্তন মানেই ভিন্ন মতাবলম্বীর মন্তব্য। এ কথা সত্য। যে দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবর্তনের দুয়ার খোলা হয় এটি শতভাগ, পৃথিবীর কোনো নজিরে নেই। পরিবর্তনের পরবর্তী ধাপ সফল-অসফল বা আশানুরূপের চেয়ে ভিন্ন। এভাবেই পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাব্যবস্থার যে পরিবর্তন এসেছে। অভিভাবক তথা শিক্ষাবান্ধব প্রায় অনেকের মনে ক্ষোভ আর হাস্যপরিহাসের অন্ত নেই। কথা হলো- ভালো শিক্ষা বলতে আসলে কী? তিন-চার বছরের একটি বাচ্চাকে দশটি পাঠ্যধারার সঙ্গে যুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া। অধিক পরিমাণের যানবাহন ও যাত্রীসংখ্যার ভিড়ে, মস্ত ব্যাগসহ আদরের সন্তান নিয়ে দু-চার বেলা করে রাস্তা পারাপার। এতো বই এতো পড়ালেখা, বাচ্চারা হাসতে ভুলে যায়। ভয়ে থাকে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে। এসবের প্রভাবে কিছুটা দুর্বল মনে হলেই পিটিয়ে খাবার দেওয়া। হর্ষ উৎসাহের দ্বারপ্রান্তে না গিয়ে নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতায় ফেলে দেওয়া। অতিরিক্ত হোমওয়ার্কের জন্য বাসায় মা মমতাহীন কৌশল অবলম্বন করা। ভালো শিক্ষা বলতে কী শুধু ব্যবসাকেন্দ্রিক? অলিগলি কোনো একটি ফাঁকা না রাখা। কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট সেন্টার, হাতের লেখা সুন্দরকরণের সেন্টার। এভাবে আলাদা আলাদা অর্থক্রয়ের শিক্ষা গ্রহণ করে বেকারত্বের অংশী হওয়া। মাসের মাস কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে না গেলে তাকে স্কুলমুখী না করে প্রাইভেটে ঠেলে দেওয়া। বাংলাদেশের ধারা অনুযায়ী একজন মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর জন্য নি¤েœ দশ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা। এমন অভিভাবক কী গণনা করা হয়েছে। তাদের অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ একত্রে পঞ্চাশ হাজারে দাঁড়ালে কতজন অভিভাবক স্বস্তিতে বহন করতে পারবেন। ভালো শিক্ষা বলতে কী সময়জ্ঞান নয়? সৃষ্টিকর্তা তার প্রদত্ত গুণাবলির দুটি শক্তি মানুষকে দিয়েছেন- একটি জীবনীশক্তি অন্যটি জ্ঞানের শক্তি। জীবনীশক্তি আপনাআপনি বিকশিত হয় আর জ্ঞানের শক্তি অর্জন করতে হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি মানা খুবই জরুরি। বলছি এজন্য, আমাদের সমাজে এক শ্রেণির অভিভাবক আছেন। সন্তানের সব কিছুর মধ্যে ঢু মারেন। ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, ক্রীড়াকৌতুকে সময় নষ্ট করা যাবে না। এখন সমাজ খুব খারাপ আমাদের কালের সেই দিন নেই। মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে- কাজেই আমার সন্তানের ভালো-মন্দ আমি ঠিক করে দেব। আসলে এভাবে ঠিক হয় না। ভাগ্যবিড়ম্বনা বলে একটি বাক্য আছে আবার পরিশ্রমই সফলতার চাবিকাঠি এবং সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবহার সফলতার উৎস। এরপরও আমরা যেটিকে পারিবারিক শিক্ষা বলি এটি জাস্ট একজন শিশুকে জানান দেওয়া। সে একটি পরিবারের সদস্য। পরিবারটির পরম্পরায় নিয়মণ্ডকানুন, আচার-অনুষ্ঠান আছে। গ্রহণীয় রীতিনীতি নির্ধারণে শ্রদ্ধা রেখে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে সামাজিক ডেভেলপমেন্টে সচেতন করে তোলাই পারিবারিক শিক্ষা। শিক্ষার প্রকৃত রূপ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মস্বতন্ত্র, বর্তমানের প্রযুক্তিগত ও আচরণগত শিষ্টাচার যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কাজেই পরিবর্তন চলমান প্রক্রিয়া না হলে শিক্ষাপদ্ধতি অচল থাকার মতোই ব্যবস্থা। কেননা, সময় মস্তিষ্কের সবচেয় বড় শাসক সে প্রভাবিত করবেই। প্রতিটি জেনারেশনের মাঝেখানে সময় নিজেই শক্তিশালী দেওয়াল। সময়োপযোগী কারিকুলাম প্রতিষ্ঠা না পেলে বিশ্বদরবারে দাঁড়ানো ঘুমন্ত স্বপ্ন মাত্র। তাই অভিভাবক নিরঙ্কুশভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো একটি নিজ শিক্ষার্থীর মতো সহ-নির্বাচন করে তাকে সময়ের বাহনে ছেড়ে দেওয়া। কাজের কাজ শিক্ষক ছাত্রের কমিউনিকেশন কতখানি তা জানা। বিষয়বস্তুর পাঠ শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে জানার কৌতুহল যোগাচ্ছে কি না। সেকেলে মুখস্থ পাঠে ঘন ঘন পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন আছে। কবুতরের খুপরি ক্লাসঘর নিয়েই শিক্ষাকেন্দ্র খুলে বসা কতটা গ্রহণীয়। বাইরের দেশগুলোতে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রয়োজনে কয়েকটা বই খুঁজে নির্ভুল উত্তর লিখতে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই শিক্ষার্থীই পারবে যেই শিক্ষার্থী পূর্বে বইটি ভালোভাবে পড়েছে। এটিই পরীক্ষা। নিয়মিত ক্লাসে শিক্ষক বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বাসায় স্বল্প পরিসরে হোমওয়ার্ক শিক্ষক বুঝিয়ে দেন। পরদিন শিক্ষার্থী নিজে নিজে হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এই কথাগুলো আপা বলতেন। তিনি সপরিবারে লন্ডনে থাকেন। দেশে এলে আপার সঙ্গে আমার বাচ্ছাদের পড়াশোনা ওখানে আপার বাচ্ছাদের পড়ালেখার যে সমস্ত অমিল এসব নিয়ে প্রায়ই কথা হয়। আসলে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রাইভেটমুখী। এজন্য অভিভাবকের অত্যাচার সীমাহীন। প্রযুক্তি যেখানে জীবনধারার মান সহজ করে দিয়েছে কলুরবলদ সেজে পরিশ্রম করা শিল্প নয়। সঠিক পদ্ধতি খুঁজে বের করাই হলো শৈল্পিকগুণ। ভালো শিক্ষা বলতে কী শুধুই পরিবর্তন? নাকি কোনো পরিবর্তনই নয়? অবশ্যই একটি আরেকটির ঊর্ধ্বে নয়। আমরা বাঙালি। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। একদিকে আমরা যেমন মাটির মতো সহনশীল অন্যদিকে আমাদের অধিকারের জন্য তেমনই লড়াকু। এই বাঙালির জন্য অনুসরণ, অনুকরণ নয়। এটি যেমন সত্য তেমনি সত্যি বাঙালিরা পৃথিবীর প্রায় দেশে নিজ দেশীয় তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছেন। ভিনদেশে বসবাস করে খুঁজে বের করেন কোথায় বসে বাঙালি হাটবাজার। দেশের বাইরে থেকেও অর্জিত দিবস আনন্দের সঙ্গে পালনের মধ্যে গর্ব করেন আমাদের আছে- একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির রক্তে, মস্তিষ্কে স্থান করে নিয়েছে। সেসব সময়ের প্রতিবাদ এবং পরিবর্তন কীভাবে তা আমরা জানি। একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রতিবাদে ১৯৫২-এর আন্দোলনে বাঙালি অর্জন করেছেন। ২৫ মার্চ কালরাতের হামলার পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ২৬ মার্চ শুরু করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যা চলে নয় মাসব্যাপী। ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দিন, পরাজয়ের দিন। আমারা জয় করি বিজয় দিবস। এভাবেই আমরা শিখেছি, জেনেছি প্রতিবাদ করে, পরিবর্তন আনতে। তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় কেন নয়? পৃথিবী এগিয়ে এসেছে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের দিকে। আমরা আজও পরিভাষা আয়ত্ত করতে পারিনি। আবিষ্কারের জন্য সেই মাপে বিজ্ঞানী তৈরি করতে পারিনি। বেশিরভাগ বাইরের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর। বাইরের চিকিৎসার পদ্ধতির ওপর নির্ভর। বাইরের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি বাড়ছে আসক্তি। এটি বাঙালির দৈন্যদশা ছাড়া আর কিছু। কোনো পরিবর্তন হবে না সেকেলে থেকেই মুখেমুখে সময়কে নষ্ট বলবো। অন্তরে আসক্তি লয়ে পরিবর্তিত সময়ের গভীর জলে ডুব দিয়ে চলব অর্থহীনভাবে।

আমার ধারণা একটি প্রাইমারি শিশুকে শুধু কাগজ কাটতে দিলেও একদিন ঠিক একটি কাগজিফুল বানিয়ে দিবে। আনন্দের সঙ্গে পাঠে প্রবেশ করলে। নিত্যনতুন শেখার, জানার আবেগ তৈরি হবে। তাহলে আবেগ কি ভালো? মন্দও নয়। আবেগের মধ্যেই বিবেক বিবেচনার উন্মেষ ঘটে। দেখুন তো আলুভর্তা ডিম বাজি সবার জন্য প্রযোজ্য কি না। পিরিয়ড সর্দি জ্বর মাথা ব্যথার মতো শারীরিক পরিবর্তন মনে হলে অসুবিধা কোথায়। পিরিয়ড গোপনীতার বিষয় কি। সাইকেল চালানো, ব্যাঙ ঝাঁপ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এইটুকু খুশী এনে দিবে কি না। ভেতরে লুকিয়ে থাকা শুপ্ত প্রতিভায় নাড়া পড়বে কি না। এসব পাঠ্যবইয়ে এসেছে মাত্র শুরুটা শুরু করার জন্য তাই বলে আমরা অতিথিপরায়ণ ভুলে যাবো না কি শাড়ি পরা অথবা মাছ গোশতের বদলে ব্যাঙ কেচু সাপ খেতে শুরু করব। আমাদের সংস্কৃতিজুড়ে নববর্ষের শোভাযাত্রা, লোকসংগীত, লোকসংস্কৃতি, জামদানি শাড়ি, নঁকশিকাঁথা, মাটির হাঁরি এগুলো বাঙালির সম্পদ। বাঙালির অহংকার। চাইলে বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কেউ উদ্যোক্তা হয়ে বিশ্ববাজারে বাঙালির এই শেকড়ের গুণমান মেলে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হীনম্মন্যতাকে বাদ দিয়ে নিজ শেকড় ভালোবেসে নতুনকে বরণ করে নেওয়া। যুগ বা কালকে মন্দ বলে নয়। মহান স্রষ্টা নিজেই যুগ পরিচালনা করেন। পুরো পৃথিবীর বিপর্যয়কর পরিস্থিতি করোনা মহামারির দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থা কেন এমন হয়? এটা কী পরিবর্তন নয়? উপজেলাভিত্তিক একটি ভালো প্রতিষ্ঠান। আধুনিক যন্ত্রপাতির সব সুযোগ-সুবিধার মধ্যে উচ্চতর মননশীল ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক ধারা পরিচালিত। যেখানে থাকবে গ্রন্থাগার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাধ্যতামূলক করে উন্মুক্ত অথচ বাংলাদেশ প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার আছে এটি যেন নিষিদ্ধ কক্ষ। গবেষণাগার, উদ্ভিদ পরিচর্যাকেন্দ্র, শরীরচর্চাকেন্দ্র, সাঁতারালয়, স্বাস্থ্যসম্মত পাকঘর আর সবচেয়ে বেশি যেটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সাংবিধানিক নিয়মণ্ডকানুন, আইনিশৃঙ্খলা বিষয়ভিত্তিক করে প্রাথমিক স্তর থেকে শেখানো।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ভালো শিক্ষক কেন যাবে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত উপজেলাগুলোতে? এজন্য যাবে, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করতে। আঠারো কোটি জনতার বাংলাদেশে কমপক্ষে পাঁচ লাখ শিক্ষক। জ্ঞানী, গুণী ও আদর্শবান করে গড়ে তোলা সরকারের দায়িত্ব। দেশের মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা সরকারের দায়িত্ব। এখানেও প্রশ্ন, আমাদের শিক্ষকগণ কী জ্ঞানী নয়? আমি মনে করি, এক জীবন পড়ে কেনো ব্যক্তি মেধা মননের সাগরে ডুবে থাকেননি। মেধা মননে শানিত ধরে রাখতে হলে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত পড়াশোনা শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য। কারণ, একটি দেশের সব ধরনের পেশার ঊর্ধ্বে শিক্ষক। যিনি ডাক্তার হওয়ার শিক্ষা দেন, বিজ্ঞানী হওয়ার শিক্ষা দেন, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার শিক্ষা দেন, প্রকৌশলী হওয়ার শিক্ষা দেন, রাজনৈতিক শিক্ষা দেন, অর্থনৈতিক শিক্ষা দেন, সামাজিক শিক্ষা দেন, ধর্মের শিক্ষা দেন, কর্মের শিক্ষা দেন তিনি হচ্ছেন শিক্ষক। এপর্যায়ের একজন শিক্ষককে কেন খেতে হবে ডালভাত? বাড়ি থাকবে না? গাড়ি থাকবে না? চিকিৎসা থাকবে না? অতি সাধারণ জীবন-যাপনের মধ্যে মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করার প্রাণশক্তি কীভাবে আসবে? দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যালয় থেকে ছাত্রনেতা তৈরি হয়। তাদের দেশে, দেশের বাইরে বাড়ি থাকে গাড়ি থাকে আত্মীয়কুল দাপটের সঙ্গে জীবনযাপন করে। তাদের দিকে দৃষ্টি আসে উপর মহলের সাধুসঙ্গের।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত