ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শহিদ জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ

রায়হান আহমেদ তপাদার
শহিদ জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ

শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ একটি যুগান্তকারী ধারণা, যা আমাদের জাতিগত পরিচয়ে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর, যখন পুরো জাতি একটি সত্তার সন্ধানে ছিল, তখন শহিদ জিয়া তার সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদকে একটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণে উপস্থাপন করেন। তার শব্দগুলো আমরা ধর্মে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; ভাষায় বাঙালি, কিন্তু একত্রে আমরা বাংলাদেশি- আজও আমাদের আবেগতাড়িত করে। এই প্রথাগত চিন্তা আমাদের বিভক্তির প্রাচীর ভেঙে, বাঙালি ও মুসলিম পরিচয়ের সীমানা পেরিয়ে একটি সম্পূর্ণ জাতির পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে। অসাধারণ প্রতিভা এবং সাহস ছিল বলেই একজন মেজর পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করার মনোবল দেখাতে পেরেছিলেন এবং সমস্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেই যুদ্ধের অগ্রগামী নেতৃত্বের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। একজন দূরদর্শী সামরিক স্ট্রাটেজি নেওয়ার সমস্ত গুণই ওই বয়সে তার মধ্যে পরিস্ফুটিত দেখা গেছে। সামরিক প্রতিভার সঙ্গে রাজনৈতিক সংকটের গভীরতা অনুধাবনের ক্ষমতা এবং দূরদৃষ্টির সমাবেশ ঘটেছিল তার মধ্যে। দেশের জাতীয় ইতিহাসে যে ক’জন রাজনীতিক তাদের অসামান্য নেতৃত্ব, সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার মাধ্যমে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাদের মধ্যে প্রধানতম। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ধাপ ছিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গঠিত এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে রাতে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে তিনি শহিদ হন। তার এই অকাল প্রয়াণ জাতির হৃদয়ে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি। তার স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেন। তার এই সাহসিক ঘোষণা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর। যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীতে থেকে দেশ গঠনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি জাতীয় নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে আসেন এবং ১৯৭৭ সালে গণভোট ও পরে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনা। তিনি দেশের জনগণকে আত্মনির্ভরতার পথ দেখিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭৫ সালে কয়েকবার ক্ষমতার রদবদল হয়। কিন্তু শহিদ জিয়া কারও সঙ্গে যোগ দেননি। তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সিপাহী জনতাই তাকে ক্ষমতায় বসানোর কাজটি করেন। তিনি নিজে ইচ্ছা করে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। ৭ই নভেম্বরের পর আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের দিক থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিরুদ্ধে বারবার হুমকি ও হামলা এসেছে। কিন্তু শহিদ জিয়ার ইস্পাত কঠিন নেতৃত্বেই গোটা দেশপ্রেমিক শান্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করে এবং সমগ্র বিশ্বের সমর্থন অর্জন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে তিনি রক্ষা করেন। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা নেতা। যিনি একদলীয় শাসনের পর একটি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তার শাহাদাতের পর নেতৃত্বের একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে; এর ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি গাঢ় হয়। ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কলুষিত করে তোলে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পাদণ্ডপ্রদীপের সামনে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব বিস্ময়কর ঘটনা। তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী পুরুষ। শহিদ জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তার ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন ভিশনারি, এক স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্তভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব। শহিদ জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম, পরিশ্রমপ্রিয়তা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলী এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। শহিদ জিয়া গণতান্ত্রিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের জনগণ একবার যদি গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার ভোগ করে; তবে তা সারা জীবন জারি রাখতে হবে। কোনো কারণে সে অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হলে গণঅসন্তোষ দেখা দেবে, মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসবে, তাই তিনি সব অধিকারের বিষয়ে ছিলেন সজাগ-আস্থাবান। তিনি জানতেন রাজনৈতিক অধিকার ব্যতিরেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থহীন, অর্থনৈতিক মুক্তি অবাস্তব- তাই তার ১৯ দফা কর্মসূচিকে তিনি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রেখে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন; যাতে জনগণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধা একসঙ্গে ভোগ করতে পারে। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তিনি নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন; তার জন্য জনগণকে কোনো দাবি বা আন্দোলন করতে হয়নি। এজন্য তিনি দেশের মানুষের কাছে চিরকাল শ্রদ্ধাভাজন হয়ে থাকবেন। দেশের বিরাজমান প্রেক্ষাপটে শহিদ জিয়া বড় বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। শহিদ জিয়া জীবিত থাকলে হয়তো বাংলাদেশের অবস্থা এরকম হতো না, হতে পারত না। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন যদি আসে তাহলে তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে কার্যত শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে বন্ধ্যাত্ব শুরু হয়েছিল শহিদ জিয়াই তা থেকে জাতিকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনিই প্রথম বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শাসকরা যেখানে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে শহিদ জিয়া উৎপাদনমুখী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। প্রকৃত বিবেচনায় শহিদ জিয়ার সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সহনশীলতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা দেশ বিনির্মাণে যে পথের দিশা দেখিয়েছিল তা যদি অনুসরিত হতো বা হতে পারত অথবা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যেত তাহলে বিজয়ের ৫৪ বছরে মূলত হতাশার পরিবর্তে আশার কথাই বেশি শোনা যেত। শহিদ জিয়ার নেতৃত্বে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে প্রবলভাবে স্থান পেয়েছে, যা আমাদের সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে আরও মজবুত করেছে। তার চিন্তা ও দর্শন আজও আমাদের হৃদয়ে জীবন্ত, আমাদের পথপ্রদর্শক-একটি গর্বিত ও স্বাধীন জাতির স্বপ্নের চেতনায়। শহিদ জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি আন্দোলন, যা আজও আমাদের সামনে প্রেরণা জোগায়। শহিদ জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে ভাবনা আমরা দেখতে পাই, যেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশ থাকবে ঐক্যবদ্ধ, প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে মর্যাদা এবং আইনের সুশাসন পাওয়ার অধিকার। তার সেই আদর্শের জায়গায় যদি আমরা এক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম, তবে আজ আমাদের বৈষম্য দূর করার জন্য আন্দোলন করতে হতো না কারণ শহিদ জিয়ার আদর্শে বৈষম্যের কোনো স্থান ছিল না। শহিদ জিয়ার কাছে গণতন্ত্র শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থাই ছিল না। গণতন্ত্রকে তিনি দেখেছেন এক জীবন ব্যবস্থা রূপে, তাই জীবনকে সুন্দর করার জন্য যা যা প্রয়োজন তিনি সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। শিল্পকলা থেকে শিশু একাডেমি, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিএনসিসি, রাজনৈতিক থেকে আঞ্চলিক সংস্থা, কৃষির অগ্রগতি থেকে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ক্রীড়ানুষ্ঠান থেকে সংস্কৃতি চর্চা, গ্রাম সরকার থেকে দেশের সার্বোচ্চ বিচারালয়ের স্বাধীনতা সব ক্ষেত্রে ছিল তার অবাধ বিচরণ। আজকের বাংলাদেশের চার দেওয়ালের যেদিকে তাকাই না কেন, সব দিকেই রয়েছে তার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আজও চিরঞ্জীব হয়ে আছে। আজকে আমাদের দেশের অনেকেই বাঙালি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে চায়, কিন্তু বাঙালি বলতে গেলেই আমরা যে মানচিত্র রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছি সেই মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত অনেক মানুষকেই অস্বীকার করা হয় বরং ভিন্ন দেশের কিছু মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে যায়। বাংলাদেশ নামের শব্দটার মাঝে যে অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ লুকিয়ে আছে তা আমাদের স্বাধীনতার আদর্শকে সমুন্নত করে। আর ঠিক সেই বিষয়টাই বুঝতে পারেন শহিদ জিয়া, অনুভব করেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এভাবে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের শেখান যে, একটি জাতির পরিচয় কেবল একাধিক উপাদানে নয়, বরং সেগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। তার চিন্তার মাধ্যমে আমরা আজ বুঝতে পারি, আমাদের শক্তি আমাদের বৈচিত্র্যে; এবং এই বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে আমরা একসঙ্গে গড়ে তুলতে পারি একটি সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক বাংলাদেশ।

তার আদর্শ আজও আমাদের প্রেরণা দেয়, যেন আমরা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে গর্ব অনুভব করতে পারি। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কতখানি জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন তা আমরা অনুধাবণ করতে পারি তার শহিদ হওয়ার পর ঢাকার দৃশ্য থেকে। তার দেহাবশিষ্ট শেষবারের মতো দেখার জন্য এবং তার জানাজায় ২০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি এক বিস্ময়কর ঘটনা। জনগণের অত্যন্ত প্রিয়নেতা আমাদের মধ্যে নেই সত্য কিন্তু তিনি আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত