প্রতিবেশীদের মধ্যে বন্ধন হলো প্রতিবেশ। ভালো প্রতিবেশ না হলে যেমন নির্মল পরিবেশ পাওয়া যায় না। নির্মল পরিবেশের অভাবে টেকসই জীববৈচিত্র্য গড়ে ওঠে না। ঠিক তেমনি বিশ্বব্যবস্থায় ভালো প্রতিবেশী না হলে সুস্থ ও সুন্দর রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। সুতরাং নাগরিকদের জন্য সমৃদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে ভালো প্রতিবেশী রাষ্ট্র অপরিহার্য। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে পুশইন এবং পুশব্যাক নিয়ে উত্তেজনা প্রকাশ্যে এসেছে। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটির সম্পর্কের গভীরতা ও জটিলতা যেন তার সমস্ত অবয়ব নিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ এমন একটি সম্পর্ক বজায় রাখে সেটি যেমন জটিল তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি অনেক কারণেই ঘটছে এবং এর পেছনে প্রধানত রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়ের জটিলতা রয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকেই প্রত্যক্ষ করা গেছে বিশৃঙ্খলা ও গণহারে সীমান্ত দিয়ে পুশইন হওয়া মানুষের মিছিল। এরা স্বদেশত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছে এবং হচ্ছে শাসক সম্প্রদায়ের নির্যাতনের দ্বারা। এই পরিস্থিতির কারণে সমগ্র উপমহাদেশে একটি ভূরাজনৈতিক প্রভাব পড়বে। দুঃখের বিষয় মানবাধিকার কর্মীরা রাজনীতিবিদদের চাপে রাষ্ট্রের এই হীনম্মন্য আচরণের দায়ভার এড়াতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির সীমান্তজুড়ে নৈতিক দায়িত্বের বিষয়টি অবহেলিত হয়ে পড়ছে। অসহায়ত্বকে পাথেয় করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রদুটির মধ্যে বিদ্যমান অন্যান্য সমস্যাগুলোও কিন্তু সমাধান হবে না। প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে বাংলাদেশ সর্বদা বাণিজ্য, সংযোগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়গুলোতে ভারতকে সহযোগিতা করে এসেছে। কিন্তু ভৌগোলিক আকার, ক্ষমতা ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের নামে ভারত সর্বদা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব পোষণ করে এসেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা ৪১৫৬.৫৬ কিলোমিটার। যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক সীমানা। সীমান্তে পুশইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে যেভাবে জটিল ও কূটনৈতিক করে তোলা হচ্ছে তাতে করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে সহাবস্থান অনেকটা বিপজ্জনক রূপ লাভ করবে। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে উত্থান ঘটবে উগ্র জাতীয়তাবাদের। আন্তর্জাতিকভাবে পুশইন প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ সীমান্তে এই কর্তৃত্ববাদী আচরণ চলে আসছে, যেটা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত স্বীকার করে না। অবৈধভাবে পুশইনের জন্য ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পয়েন্টে মানুষ জড়ো করে রাখার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে নতুন এ কৌশল বেছে নিয়েছে। পুশইনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে অবস্থান করছে আসাম রাজ্যের দরিদ্র ও শ্রমজীবী জনগণ। মুম্বাইয়ের নাগরিক সমাজভিত্তিক সংগঠন ‘সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ (সিজেপি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে আসাম রাজ্যের শত শত ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি বলে অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে (পুশইন) পাঠানো হচ্ছে। সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী তিস্তা শেতলবাদের নেতৃত্বাধীন সংস্থাটি জানিয়েছে, আসামের ৩৩টি জেলায় নারী, শিশু ও পুরুষদের বেআইনিভাবে আটক করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। সিজেপির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৩ মে থেকে হঠাৎ রাজ্যের ৩৩ জেলায় পুলিশি অভিযান শুরু হয়। কোনো মামলা, নোটিশ বা আইনি ব্যাখ্যা ছাড়াই প্রায় ৩০০ মানুষকে আটক করা হয়। সাংবিধানিক ও আইনি নিয়ম লঙ্ঘন করে তাদের আনুষ্ঠানিক নির্বাসন আদেশ বা দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশি টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্তে পুশইন করা হয়। পুশইনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এ রাজ্যের বাংলাভাষী মুসলমানরা। সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে আসাম রাজ্যের বাংলাভাষী ভারতীয় নাগরিকদের বিশেষ করে মুসলমানদের ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালের’ মাধ্যমে নাগরিকহীন করে সিলেটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। এ ধরনের একাধিক খবর এরইমধ্যে আসামের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আসামের বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক পত্রিকা ‘যুগশঙ্খ’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও শিলচরের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অতীন দাশ আসামে বাংলাভাষী ভারতীয়দের উপর চলমান পুশইন নামক অমানবিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন হৃদয়ের মর্মব্যথায়। তিনি বলেন ‘বাংলায় কথা বলাই যেন আমাদের অপরাধ’। অথচ সমগ্র ভারতে প্রায় ১৬০০ ভাষা প্রচলিত রয়েছে যার মধ্যে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ভাষা ২২টি। এই সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ২২টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম ভাষা। এই বাংলা ভাষা ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই শুধু মাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে একজন ভারতীয় নাগরিককে অভারতীয় তকমা লাগিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পুশইন করা আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্টতই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। সিলেটের বিয়ানীবাজার, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রৌমারীর প্রত্যন্ত চর এলাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনবসতিহীন এলাকা দিয়ে রাতের আঁধারে পুশইনের ঘটনা বেশি ঘটছে। পুশইন অব্যাহত রাখা এসব মানুষের মধ্যে ভারতের রেজিস্ট্রার করা রোহিঙ্গা পাওয়া গেছে যারা ভারতের ইউএনএইচসিআর (জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কমিশন) এর শরণার্থী। বিশ্ববাসীর জানা দরকার যে, এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। গত ৭ মে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পুশইন করানো হয় ১২৩ জন, ৯ মে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জন, ১৪ মে সিলেট ও মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে আরও ৬০ জন, ৩ জুন পঞ্চগড়ের হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের বড়বাড়ি সীমান্ত সীমান্ত দিয়ে ৯ জন এবং চাকলাহাট ইউনিয়নের ক্ষণিয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে পুশইন করা ১৭ জনকে আটক করে শিংরোড বিওপি ক্যাম্পের সদস্যরা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে ২২ জনকে দিবাগত রাত আনুমানিক ১টার দিকে ১১৪১-এর ৮.এস পিলার মুন্সিপাড়া বিওপি এলাকা দিয়ে, ৪ জুন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর সীমান্ত দিয়ে ৩২ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ। গত ৮ জুন বিবিসির সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আসামের মরিগাঁও গ্রামের স্কুলশিক্ষক খইরুল ইসলামসহ প্রায় ৩০০ জন ভারতীয় নাগরিককে আসামের সালমারা এবং বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্তের মাঝামাঝি নোম্যান্স ল্যান্ডে হাত বেঁধে ফেলে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। একজন শিক্ষকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করলে অসহায় ও দরিদ্র বাংলাভাষী ভারতীয় জনগণের কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। সীমান্তে ভারতের পুশইন সুপরিকল্পিত যা বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমনিতেই সীমান্ত হত্যা ও আন্তঃসীমান্ত নদ-নদী নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক আধিপত্যবাদী আচরণ মোটেও সুফল বয়ে আনবে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, নেপাল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড রয়েছে। ভৌগোলিক বৈরী সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো সীমান্তে এরূপ পুশইন সংঘটিত হয় না। এই কর্মকাণ্ডগুলো বলে দেয় বন্ধুত্বের বুলি আওড়ানো সম্পর্ক বাস্তবে কী! ভারত তার চারপাশে যেসব প্রতিবেশী আছে তাদের সঙ্গে ক্রমশ সম্পর্ক হারাচ্ছে। পৃথিবীতে একমাত্র রাষ্ট্র ভারত, যার কোনো একটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নেই। দাদাগিরি, অসম্মান ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে সব প্রতিবেশী রাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভারত থেকে। ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখা হয় নেপালকে। কিন্তু ধারাবাহিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। চীনের বলয়ে চলে গেছে নেপাল। ভুটানও অনেকটা সেই পথে। সম্প্রতি মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ নয়। প্রতিবেশী সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও চীনের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য, অর্থনীতি, আন্তঃনদী সংযোগ, কানেক্টিভিটি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ভারতের চাণক্য কূটনীতির কারণে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে সম্পর্ক বরাবর তলানিতে। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয় বহু আগে থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্ত দিয়ে পুশইন করা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে। যা উপমহাদেশীয় আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানকেই তুলে ধরে। যে কোনো রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বড় ভূমিকা থাকে তাই ভারতের উচিত নিরীহ মানুষকে সীমান্তে পুশইন না করে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে কোনো ব্যক্তির বাংলাদেশি নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হলে বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়া মেনে হস্তান্তর করা হোক। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সর্বাগ্রে দরকার বুকের ভেতরে অঙ্কিত সংকীর্ণতাকে মুছে ফেলে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের সার্থকতা সৃষ্টি করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে বিএসএফ যে আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করেছে তার যথাযথ প্রতিবাদ করবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের এই আধিপত্যবাদী আগ্রাসী চেহারার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরবে। সীমান্তে এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ কখনও চায় না ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়ে একটি তিক্ততার সৃষ্টি হোক। যদি হয়ও তা হবে সীমান্তে ভারতের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের জন্য। এখন দেখার বিষয় উভয় দেশের সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায়।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট