ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ করতে হবে

জালাল উদ্দিন ওমর
সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ করতে হবে

বাংলাদেশ এবং ভারত পাশাপাশি রাষ্ট্র, পরস্পরের প্রতিবেশী। দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) প্রায়ই বাংলাদেশিদের হত্যা করে। বছরের পর বছর ধরে বিএসএফ এ হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। বাংলাদেশ হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানালেও, বন্ধ হয়নি। এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভারত বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও তা কার্যকর করেনি। ফলে নিয়মিতভাবেই সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা চলছে। সীমান্ত নিরাপত্তায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দায়িত্ব পালন করলেও, এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে তারা বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এভাবে ভারত কর্তৃক সীমান্তে নিরপরাধ বাংলাদেশি হত্যা চলতে পারে না। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাই। এসব হত্যাকাণ্ড চিরতরে বন্ধ করতে হবে। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রেডক্লিফ লাইন নামেই পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় এ বর্ডার লাইন নির্ধারিত হয়। ভারত-পাকিস্তান বর্ডার কমিশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ আইনবিদ স্যার সিরিল রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট এটি নির্ধারণ করেন। আজকের বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ভুখণ্ডের সঙ্গে ভারতের নির্ধারিত সীমানাই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত লাইন। ভারতের পাঁচটি অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। আসামের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার, মিজোরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ২২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর এবং ময়মনসিংহ ছয়টি বিভাগের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংযুক্ত। সীমান্তে ভারত দীর্ঘদিন থেকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এরইমধ্যে প্রায় ৩১৮০ কিলোমিটার বেড়া নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। বাকি ৯১৬ কিলোমিটার সীমান্তে ঘন বনভূমি, উঁচু পর্বতমালা, নদীপথ এবং জলাভূমি থাকায় বেড়া নির্মাণ করতে পারেনি। সীমান্তে হত্যা এবং বেড়া নির্মাণ বন্ধুত্বের কোনো নিদর্শন নয়। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৫-২০২৪ পর্যন্ত ১০ বছরে বিএসএফ ৩০৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে ৪৩ জন, ২০১৬ সালে ২৮ জন, ২০১৭ সালে ৩০ জন, ২০১৮ সালে ১৫ জন, ২০১৯ সালে ৪২ জন, ২০২০ সালে ৫১ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন, ২০২৩ সালে ৩০ জন এবং ২০২৪ সালে ২৬ জনকে হত্যা করেছে। তারা ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত আরও ১০ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। বিএসএফ জওয়ানদের গুলিতেই এসব নিরীহ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া তাদের হামলায় বিভিন্ন সময়ে বহু বাংলাদেশি আহত হয়েছে এবং এদের কেউ কেউ পঙ্গু হয়েছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানী খাতুন নামের ১৫ বছর বয়সি বাংলাদেশি মেয়েকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। পরদিনই তার বিয়ের কথা ছিল। তার লাশ দীর্ঘ সময় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলেছিল, যার ছবি সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফেলানী হত্যায় জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষসহ অন্যদের ভারতের আদালত খালাস দেয়। ভারতের সুপ্রিমকোর্টে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলেও এখনও সে বিচার সম্পন্ন হয়নি। বিএসএফ ২০২৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বর্ণা দাস এবং ৯ সেপ্টেম্বর ১৫ বছরের জয়ন্ত কুমার সিংহকে হত্যা করে। স্বর্ণা দাস তার মায়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় বসবাসরত ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যাচ্ছিল। এভাবে ভারত সীমান্তে নিরাপত্তার নামে নিরপরাধ বাংলাদেশিদের হত্যা করে চলেছে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক নীতিমালা রয়েছে। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পাদিত দুটি চুক্তি হচ্ছে- জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ এবং দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট পল্যান, ২০১১। জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ অনুসারে এক দেশের নাগরিক যদি বেআইনিভাবে অন্য দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে বা কোনো অপরাধে জড়ায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষায় যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে, তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করাটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ভারত এসব চুক্তি মানছে না। সীমান্তে কোনো বাংলাদেশি আইন ভঙ্গ করে অপরাধ করলে তাকে আটক করে আইনের আওতায় আনা এবং বিচার করে শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু বিএসএফ তা অনুসরণ করে না। তারা কিছু হলেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে। সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএসএফ এবং বিজিবির মধ্যে অনেক বৈঠক হয়েছে এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকেই বিএসএফ, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিএসএফ কখনওই তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ফলে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা আগের মতোই অব্যাহত আছে এবং নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশিরা মারা যাচ্ছে। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের চীর অবসান চাই। প্রয়োজনে এ ইস্যু আন্তর্জাতিক ফোরাম বিশেষ করে জাতিসংঘে উত্থাপনের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাই। ভারতের মতোই বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এ বাস্তবতা ভারতকে মানতে হবে। বাংলাদেশ সব সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। প্রতি বছর বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশি চিকিৎসা, ব্যবসা এবং পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে ভারতে যায়। প্রচুর ভারতীয়ও বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্ত এলাকার বহু মানুষ নিজেদের মধ্যে বিয়ে-শাদির মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তুলেছে। দেশ দুটির মধ্যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে। সীমান্তে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পাদনে একাধিক নদীবন্দর, স্থলবন্দর এবং কাস্টম হাউস রয়েছে। অনেকগুলো সীমান্ত হাট রয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে বাস এবং ট্রেন চলাচল বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত এবং নদী রয়েছে। কিন্তু ভারত সব সময় সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা এবং বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর ন্যায্য পানি হতে বঞ্চিত করে চলেছে। কিছু হলেই ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা প্রদান এবং বাংলাদেশে আলু, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং অপরাধীদের ভারত নিরাপদ আশ্রয় দেয়। ফলে বাংলাদেশ সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এসবের অবসান চাই।

লেখক : প্রকৌশলী ও রাষ্ট্র চিন্তক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত