২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি, রাষ্ট্রদূত ফিলেমন ইয়াং-এর নেতৃত্বে আহূত এই সম্মেলনটিকে অভিহিত করা হচ্ছে আমাদের সময়ের অন্যতম লজ্জাজনক মানবিক ট্র্যাজেডির শান্তিপূর্ণ সমাধানে একটি মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত হিসেবে। কিন্তু স্পষ্ট করে বলা দরকার, এ বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে বিশ্ব যা চায় তা আরেকটি সৌজন্যপূর্ণ কূটনৈতিক জমায়েত নয়, যেখানে অনর্থক বিবৃতি আর সদিচ্ছার ঘোষণা দেওয়া হবে। বরং যা প্রয়োজন তা হলো এক সাহসী, কর্মভিত্তিক প্রতিশ্রুতি- একটি নির্মম অবিচারকে সংশোধনের প্রত্যয়, দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি এবং রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা। তাদের শরণার্থী হিসেবে নয়, বরং মিয়ানমারের পূর্ণ অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক হিসেবে। এই সম্মেলনের সূচনা ঘটে ২০২৪ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে, যখন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানান।
তিনি একটি নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তির আহ্বান জানান, যাতে রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা যায়। এর জবাবে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ওই বছরই সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যা ২০২৫ সালের সম্মেলনের পথ সুগম করে দেয়। সেই থেকে বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য নিযুক্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে। তিনি রাষ্ট্রদূত ইয়াং-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন যাতে এই সম্মেলন যথাযথ বৈধতা ও কার্যকারিতা উভয়ই অর্জন করতে পারে।
রাষ্ট্রদূত ইয়াং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ ও বাস্তবমুখী ফলাফলের লক্ষ্যে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করা হবে। এই ভাষা আশাব্যঞ্জক বটে। কিন্তু অতীতের আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়- প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবায়নের অভাবে পড়ে, তবে তা প্রাসঙ্গিকতা হারানোর প্রথম ধাপ হিসেবেই পরিগণিত হয়। এই সম্মেলনের গুরুত্ব বোঝার জন্য শুধু মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালেই যথেষ্ট। জাতিসংঘের মতে, দেশটি এখন আত্মবিনাশের পথে হাঁটছে। গৃহযুদ্ধ, সামরিক সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ ভাঙন এখন সেখানে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা।
২০২৫ সালের মার্চে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও উদ্ধার তৎপরতার জন্যও সংঘর্ষে বিরতি আসেনি। সেনা শাসকগোষ্ঠী, যারা শূন্য-ফল যুক্তি অর্জনের মানসিকতা দ্বারা চালিত এবং অস্ত্রের অব্যাহত প্রবাহে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, তারা প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো দমন করতে বদ্ধপরিকর। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ৬,৬০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। ২২,০০০-এর বেশি রাজনৈতিক বন্দি এখনও কারাগারে আটক রয়েছে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম, সাবেক নেত্রী অং সান সুচি ও রয়েছেন। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখন সেখানে এক দুরাশা। আর ২০২৫ সালের শেষ কিংবা ২০২৬ সালের শুরুতে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের আভাস থাকায়, সামনে আরও রক্তপাত ও গভীর অস্থিরতার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। এই অন্ধকার চিত্রের ভেতর রোহিঙ্গাদের দুর্দশা আরও বেদনাদায়ক ও করুণ।
২০১৭ সালের তথাকথিত ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের’ (যা মূলত জাতিগত নির্মূলের আরেক নাম) পর ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট, রোহিঙ্গাদের সমাজ ও রাজনীতির পরিসর থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। আর যারা এখনও রাখাইন রাজ্যে রয়ে গেছে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা- তারা চরম দারিদ্র্য, জোরপূর্বক নিয়োগ, নির্যাতন এবং কাঠামোগত বর্জনের মধ্যে দিনযাপন করছে। উত্তর রাখাইনে প্রায় ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা নাগরিক চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে মানবিক সহায়তা বহর প্রায়ই তাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে উভয় পক্ষের নতুন রিক্রুট অভিযান, যা রোহিঙ্গা বেসামরিক মানুষদের এক অনাহূত যুদ্ধে বলির পশুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে। এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে, আসন্ন সেপ্টেম্বরের সম্মেলন শুধু নৈতিকার ভান বা প্রতীকী সংহতির মঞ্চ হলে চলবে না। যদি এই সম্মেলন সফল হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হতে চায়, তাহলে এটি চারটি মূল লক্ষ্য পূরণ করতেই হবে। প্রথমত, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাধ্যতামূলক কাঠামো তৈরি করতে হবে। এর অর্থ হলো- নির্ধারিত সময়সূচি, স্বাধীন যাচাইকরণ প্রক্রিয়া এবং দৃঢ় আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি নিশ্চিত করা। অর্ধেক পথে থেমে যাওয়া উদ্যোগ কিংবা অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি শুধু মিয়ানমারের জেনারেলদের আরও সাহসী করে তুলবে এবং বাংলাদেশের মত আশ্রয়দাতা দেশগুলোর ধৈর্যচ্যুতি ত্বরান্বিত করবে, যারা বিগত প্রায় এক দশক ধরে মানবিক এই বোঝা বইছে। দ্বিতীয়ত, এই সম্মেলনে সংকটের মূল কারণগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। নাগরিকত্বহীন প্রত্যাবাসন এক নিষ্ঠুর প্রহসন। যত ত্রাণই দেওয়া হোক না কেন, কিংবা যত সদিচ্ছাই প্রকাশ করা হোক, মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের যে আইনি স্বীকৃতি প্রাপ্য, তার কোনো বিকল্প নেই। এই প্রশ্নের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত, কোনো প্রত্যাবাসনই স্বেচ্ছাসাপেক্ষ কিংবা মর্যাদাপূর্ণ হবে না বরং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা শুধু একটি ব্যয়বহুল অস্থায়ী ব্যবস্থায় পর্যবসিত হবে। তৃতীয়ত, মানবিক প্রয়োজনে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণসামগ্রীর অবাধ প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তা একান্ত জরুরি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি দৃঢ় সরবরাহ ব্যবস্থা ও কূটনৈতিক চ্যানেল গড়ে তুলতে হবে যাতে ত্রাণ কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়। যেসব দেশের মিয়ানমারের উপর প্রভাব রয়েছে- বিশেষ করে চীন, ভারত ও আসিয়ান- তাদের এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে। রাখাইনে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় চলছে, তা শুধু একটি নৈতিক কলঙ্ক নয়, বরং গোটা অঞ্চলেই অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে পারে। দারিদ্র্য, বাস্তুচ্যুতি ও সামরিকীকরণ- এই তিনটি একসঙ্গে মিলে এক বিপজ্জনক মিশ্রণ তৈরি করছে। চতুর্থত, এই সম্মেলনের মাধ্যমে মিয়ানমারের জেনারেলদের আন্তর্জাতিক চাপকে উপেক্ষা করার সুযোগ একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। এর অর্থ হলো- নির্দিষ্ট করে দোষীদের নাম প্রকাশ করা, লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং কূটনৈতিকভাবে জান্তা সরকারকে বিচ্ছিন্ন করা। পাশাপাশি, মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো এবং আসিয়ানকে শুধু সৌজন্যমূলক আহ্বান নয়, বাস্তব পদক্ষেপে যুক্ত করাও অপরিহার্য। যদি আসিয়ান বিশেষ দূত ওসমান হাশিম এবং জাতিসংঘ দূত জুলি বিশপ শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্তরিক হন, তবে তাদের একই কণ্ঠে ও জোরালোভাবে কথা বলতে হবে। এই সম্মেলন যাতে নৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়, তার জন্য অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। এতে শুধু আঞ্চলিক শক্তি ও দাতারা নয়, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদেরও যুক্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কিছুই যেন রোহিঙ্গাদের অনুপস্থিতিতে নির্ধারিত না হয়। তাদের কণ্ঠ, তাদের দাবি এবং তাদের প্রত্যাশা- এই পুরো প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। তদ্ব্যতীত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও ভারতসহ প্রধান ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলোর এখন আরও সক্রিয় হওয়া উচিত। বিশেষ করে যেসব দেশের মিয়ানমারের সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে কৌশলগত অস্পষ্টতার সময় আর নেই।
নিষ্ক্রিয়তার মানবিক ও ভূরাজনৈতিক মাশুল এখন এতটাই বেশি যে, তা আর গ্রহণযোগ্য নয়। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক সম্মেলন জাতিসংঘের ‘সদিচ্ছাপূর্ণ জমায়েত’-এর ক্যালেন্ডারে আরেকটি সাধারণ ইভেন্ট নয়। এটি একটি পরীক্ষা- বিশ্ব সত্যিকার অর্থে মন্দের মোকাবিলা করতে পারে কিনা, অবিচার সংশোধনের ক্ষমতা রাখে কি না এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা আদৌ একটি ফাঁপা স্লোগানের চেয়ে বেশি কিছু প্রমাণ করতে পারে কি না। এই সংকট এরমধ্যেই অনেক বেশি সময় ধরে চলেছে। কিন্তু ইতিহাস কখনও জিজ্ঞেস করে না আমরা কোনো ইস্যুতে ক্লান্ত কি না ইতিহাস প্রশ্ন করে, আমরা সেটির সমাধানে কতটা দৃঢ প্রতিজ্ঞ। যদি এই সম্মেলন ব্যর্থ হয়, তার কারণ হবে না যে সমস্যাটি খুব জটিল ছিল বা পরিস্থিতি খুব কঠিন ছিল। বরং এর একমাত্র কারণ হবে নৈতিক সাহসের ঘাটতি। কিন্তু যদি এটি সফল হয় যদি বিশ্ব রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে, তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারে এবং মিয়ানমারের জন্য শান্তির একটি পথ রচনা করতে পারে- তাহলে ২০২৫ সাল শুধু আরেকটি বেদনার বছর হিসেবে নয়, বরং সেই বছর হিসেবে স্মরণীয় হবে, যখন বিশ্ব অবশেষে কার্যকরভাবে এগিয়ে এসেছিল। আমাদের আশাবাদী হওয়া উচিত বিশ্ব যেন সেই প্রত্যাশার মর্যাদা দিতে পারে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক