বিশ্ব অস্থিরতার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য সফর ছিল আলোচনায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ক্ষমতায় বসার প্রথম একশ’ দিন পার হয়েছে অনেক আগেই। এই একশ’ দিনে তিনি সব কিছু অনেকটাই উল্টে-পাল্টে দিয়েছেন। তাবৎ দুনিয়াকে এক প্রকার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। একটু এদিক সেদিক হলেই শুল্কের খড়গ নামতে পারে অথবা অন্য কোনো কৌশল। তার নেওয়া একের পর এক সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্টকে বিতর্কিত করেছে। ট্রাম্পীয় সিদ্ধান্তগুলো ঠিক গতানুগতিক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাপর নেতাদের মতের সঙ্গে অথবা পদক্ষেপের সঙ্গে হচ্ছে না। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন এক আর সিদ্ধান্ত আসছে আরেক।
এটা হতেই পারে। কিছু ভিন্নতা থাকবেই। কোনো পূর্ব মন্তব্য তাই এক রকম অসম্ভব। তবে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে জরিপে নিচে নেমেছে জনপ্রিয়তা। যে বিপুল সমর্থন নিয়ে তিনি জো বাইডেনের স্থানে এসেছেন সেখানে জনপ্রিয়তা নেমে যাওয়া তার সিদ্ধান্তগুলোর প্রতি জনসাধারণের সমর্থনের কম থাকাকেই বোঝায়।
গত ২১ মে প্রকাশিত এক জরিপের প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি জনসমর্থনের হার চলতি সপ্তাহে কমে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রয়টার্স/ইপসোসের করা এক নতুন জনমত জরিপে এমন তথ্য জানা গেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে নিয়ে যেসব জনমত জরিপ হয়েছে, সেসবের মধ্যে এটিই তার সর্বনিম্ন জনপ্রিয়তার হার। তিন দিন ধরে চালানো এ জরিপ গত রোববার শেষ হয়। এতে দেখা যায় ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন গত সপ্তাহের তুলনায় সামান্য কমেছে। রয়টার্স/ইপসোসের করা আগের সপ্তাহের জরিপে ৪৪ শতাংশ মার্কিন নাগরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের কার্যক্রম সমর্থন করেছিলেন। এবার সেই হার ৪২ শতাংশে নেমেছে।
বিশ্ব ব্যবস্থা একটি পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর আগের দশকের চেয়ে পরিস্থিতি বদলেছে। এর মধ্যেই এই সফরের আয়োজন। কোনো একটি নয় একেবারে একাধিক দেশে সফর। সেজন্য আলোচনাও ছিল বেশি। আশাও ছিল বিশ্ববাসীর যে এবার অশান্ত আরব অঞ্চল অর্থাৎ ইসরাইলকে কোনোভাবে থামানো যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২৫ সালের মে মাসের মধ্যপ্রাচ্য সফর ছিল তার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির প্রথম বড় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ।
চার দিনের এই সফরে তিনি সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। এই সফরের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো জ্বালানি নিশ্চিত করা। আর স্বাভাবিকভাবেই যেসব দেশে জ্বালানি তেল রয়েছে সেখানে বিশ্বের ফোকাসটাও সেখানেই থাকবে। আগামীর বিশ্ব যদি জ্বালানি নীতিতে সাশ্রয়ী না হয় তাহলে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হবে। সেই চাহিদা মেটানোয় লক্ষ্য ছিল। এটাই বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্ব রাজনীতি হলো গিভ অ্যান্ড টেক নীতি। যে দেশের কাছে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট জড়িত সেখানেই সম্পর্কের তোড়জোড়। ট্রাম্প যে দেশগুলোতে গেলেন সে দেশগুলোরও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং সেই সুযোগ নিয়েছেও। বিশেষত প্রযুক্তির বিষয়টা এই দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও স্বার্থ বহুবিধ হতে পারে। তা আঞ্চলিক সুবিধা আদায় হোক,বাণিজ্য স্বার্থ হোক আর তুলনামূলক প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার জন্যই হোক। তাছাড়া রয়েছে ক্ষমতায়নের বিশ্বে ক্ষমতা দখলের তোড়জোড়।
কে পৃথিবীর মুরুব্বী হয়ে খবরদারি করবে, তার সঙ্গে কোন কোন দেশ থাকবে, তাদের স্বার্থ রক্ষার উপায় কি হবে এসব বিষয়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতি গরম হয়ে আছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই এই প্রতিযোগীতা চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভেতর। সামরিকয়ান, বাণিজ্য, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি নিয়ে নতুন সমিকরণের যুগে প্রবেশ করেছে পৃথিবী। বিশেষ করে এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য উল্লেখযোগ্য। আবার বিকল্প শক্তির উৎসের দ্রুত খোঁজ করতে আরম্ভ করেছে।
ইউরোপ এখন রাশিয়ার পরিবর্তে আফ্রিকা থেকে গ্যাস সরবরাহে মনোযোগী হচ্ছে। আফ্রিকায় প্রচুর গ্যাস মজুদ রয়েছে। ফলে রাশিয়ার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ করাই মূল লক্ষ্য। আর তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে তৈরি হচ্ছে সম্পর্কের নতুন রসায়ন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শুধু একটি আনুষ্ঠানিক সফর ছিল না। এখানে কৌশলগত কয়েকটি বিষয় যা এই সময়ের বৈশ্বিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। ভূরাজনীতির এই পরিবর্তনের সময় মধ্যপ্রাচ্য সফর গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। বিশাল অঙ্কের অস্ত্র বিক্রির চুক্তিও হয়েছে এই সফরে। আর সম্পর্ক তো আছেই। এটি তখন হয়েছে যখন চীন যখন তার প্রভাব বিস্তার করছে এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো ভিন্ন পথে অগ্রসর হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য গুরুত্ব ছিল বেশি। যার মধ্যে ছিল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য বড় অঙ্কের অর্থের অস্ত্র বিক্রি, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পুনর্বায়নযোগ্য জ্বালানি। লক্ষ্যণীয় প্রতিটি উদ্যোগ এবং চুক্তিই আমেরিকাকে আর্থিকভাবে লাভবান করার সঙ্গে সঙ্গে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাইও করবে। যদিও সফর ছাড়াও সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এখন কোনো সম্পর্কই স্থায়ী থাকছে না।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগী দেশগুলো বিশেষত চীনকে এটা বোঝানো যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ঠিকঠাক অবস্থান রয়েছে। যার প্রমাণও যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে। ট্রাম্পের এই সফর তাদের ব্যাপক জাতীয় এজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, যেমন সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিল্প বৈচিত্র্যকরণ এবং কাতারের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ। গত দশকে চীন এ অঞ্চলে নিজেকে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করেছে। বন্দর, লজিস্টিকস, ডিজিটাল অবকাঠামো এবং জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলে বিনিয়োগ করেছে। মোট কথা এখানে একটি প্রতিযোগিতা রয়েছে। প্রতিযোগিতা মূলত নিজের দোদুল্যমান অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা। নিজের অবস্থান আরও বেশি স্পষ্ট করা। আজকের উপসাগরীয় দেশগুলোর মতোই সারা বিশ্বেই যে প্রতিযোগিতা চলছে।
এখানে অনুঘটক দেশগুলো সবেচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বিশ্ব যা বলছে তা হলো এই পুরো সফরের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের গাজা অভিযান নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। মানবিকতাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। যদিও সমস্যাটা আরব বিশ্বে হচ্ছিল এবং কিছু করারও ছিল কিন্তু কিছুই হয়নি। বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত নেতাদের সফরে যদিও মানবাধিকার বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে এবং নতুন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সফরে মানবাধিকার বিষয়ে যতটা গুরত্বের সঙ্গে আলোচনা হওয়া উচিত, ট্রাম্পের সফরকালে বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পায়নি। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, এসব দেশের পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। এটা আশা যদিও করা সম্পূর্ণ নিজস্ব মত। কারণ সফরের উদ্দেশ্য ছিল অধিকাংশই বাণিজ্যিক এবং পারস্পরিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির। অনেকেই এই সফরকে ‘Trumpian Spectacle’ (ট্রাম্পীয় প্রদর্শনী) বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক একটু বেশি ঘনিষ্ট। দুই দেশের দূরত্ব খুব বেশি তৈরি হয়নি।
জামাল খাশোগিকে হত্যার পর সৌদি যুবরাযের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে এর সঙ্গে পরোক্ষ সহায়তার। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব অল্প সময়ের জন্য ওঠানামা করেছিল। জো বাইডেনের সফরের পর সেই পারদ স্বাভাবিক হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার প্রায় প্রতিটি দেশেই রয়েছে বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাসসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ। এর ফলে বিশ্ব শক্তির মনোযোগ বরাবরই এ অঞ্চলে ছিল এবং এখনও রয়েছে। বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও বেশি মাত্রায়ই রয়েছে। গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে চীন, রাশিয়া ও ইরানের প্রভাব বাড়ছে। যে প্রতিযোগিতা বিশ্বব্যাপী চলছে মধ্যপ্রাচ্যও তার বাইরে নয়।
এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোরও রয়েছে হিসাব নিকাশ। এরই মধ্যে চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক ক্রমাগত উন্নয়ন ঘটেছে। বহু বছর ধরেই পৃথিবী বিকল্প শক্তির সন্ধানে হন্য হয়ে ছুটছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়া দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আপৎকালীন সংকট সামাল দিতে এই মুহূর্তে জ্বালানি সরবরাহ করা জরুরি হয়ে উঠেছে। এর জন্য পরাশক্তিগুলোর লক্ষ্য হয়ে উঠছে জ্বালানি এবং সে সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ। জ্বালানি ইস্যুতেই আবশ্যিকভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে সৌদি আরবের অবস্থান।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হিসাব নিকাশ করে এগুতে চাইছে। সরাসরি পক্ষ অবলম্বন করছে না। এটা এক ধরনের ভারসাম্য নীতির অনুসরণ করা। যুদ্ধ বিগ্রহে এ অঞ্চল অস্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চাইছে একটু হিসাব নিকাশ করে এগিয়ে যেতে।
বিশ্বব্যবস্থা কোনদিকে মোড় নেয় তার ওপর নির্ভর করবে অবস্থান কেমন হবে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের মিত্র ঠিকই এবং ইরানের সঙ্গে পারমাণিবক চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনও দীর্ঘদিনেরই তবে এখন চীনও চাইছে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রতিযোগিতা বাড়াতে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও বাড়াতে চায়। ফলে এখানেও স্পষ্ট প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের। যা বিশ্বের আরও অঞ্চলে রয়েছে। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বলছে, প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীনের সঙ্গে তাদের চলমান প্রতিযোগিতার কেন্দ্রিবিন্দু হয়ে উঠতে পারে মধ্যপ্রাচ্য। করোনা মহামারির সময় মধ্যপ্রাচ্যে স্বাস্থ্যসেবায় বেশ ব্যবসা করেছে চীন। অর্থাৎ প্রয়োজন এবং প্রতিযোগিতা শব্দদ্বয় খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। প্রয়োজনের খাতিরেই প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে এবং তা মধ্যপ্রাচ্যে এক ভিন্ন সমীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।