ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ ই-বর্জ্য

মো. তাহমিদ রহমান
পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ ই-বর্জ্য

বিশ্বায়নের ফলে দিন দিন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সামাজিকীকরণ এখন বিশ্বজুড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যবস্থা অত্যাধিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে পরিমাণ। নিত্য প্রয়োজনীয় ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, রাউটার, ক্যামেরা, এয়ারকন্ডিশনার, মাইক্রোওভেন, ইলেকট্রিক তার, সুইচ, সার্কিট বোর্ড, বাল্ব, ওয়াশিং মেশিন, মুঠোফোন, ডিভিডি প্লেয়ারের নতুন নতুন সংস্করণের আগমনে বিদায় নিচ্ছে পুরোনো সংস্করণ যার ফলে দিন দিন বেড়েই চলছে ই-বর্জ্যের স্তূপ। এসব ই-বর্জ্য থেকে নির্গত অদৃশ্য দূষণের ক্ষতিকর রেডিয়েশনের কুপ্রভাব ব্যাপক। সাত বিলিয়নের প্রাণসম্ভার এই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন ই-বর্জ্যের কারণে। শুধু ভূপৃষ্ট, সাগর মহাসাগরই নয়, মহাকাশের ই-বর্জ্যও এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহাকাশে যত বেশি মহাকাশযান যাচ্ছে সেখান তত বেশি মহাকাশ বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, যা মহাকাশের পাশাপাশি পৃথিবীকেও দূষণের কবলে ফেলছে। রকেটের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হচ্ছে, যা পৃথিবীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। বাতিল স্যাটেলাইট থেকেও ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে মহাকাশে কোটি কোটি টুকরা বর্জ্য ছড়িয়ে রয়েছে, যার মধ্যে খুব অল্প পরিমাণ বর্জ্য শনাক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর কক্ষপথ ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে। ফলে স্যাটেলাইটের নিরাপত্তা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। মহাকাশের বর্জ্য বা ধ্বংসাবশেষের টুকরাগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ ঘটছে। এভাবে সংঘর্ষ হতে থাকলে জিপিএস, মুঠোফোনের ডেটা, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের স্যাটেলাইটসহ যোগাযোগের স্যাটেলাইটগুলো ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে মহাকাশে থাকা ১ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট বর্জ্য বা ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করার পাশাপাশি লেজারের মাধ্যমে সেগুলোর গতিপথ বদলে ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যা পৃথিবীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পরিবেশ এবং মানবজাতির জন্য ই-বর্জ্য হুমকিস্বরূপ। আদিম সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন সভ্যতাকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবিত পণ্যগুলো পরিবেশে মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে। ই-বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। সাইন্সডিরেক্ট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৩৬৭ মিলিয়ন কিলোগ্রাম (৩৬৭,০০০ মেট্রিক টন) ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে, যা বার্ষিক মাথাপিছু ২.২ কেজি (০.০০৬ কেজি/ব্যক্তি/দিন), এবং উৎপন্ন ই-বর্জ্য শহরাঞ্চলের কঠিন বর্জ্যের ২.৩ শতাংশ। উৎপানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ই-বর্জ্যকে ভোক্তা-পরবর্তী সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে আবার ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যটির জীবনচক্র শেষে অপ্রাসঙ্গিক বস্তু হিসেবে গণ্য করে। যার কারণে পরিষেবাভিত্তিক পণ্যগুলোর টেকব্যাক হয় না। বহুদিন ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সূচক বলছে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯৬০ কোটিতে। এই জনসংখ্যা এবং জীবকুলের বেঁচে থাকার জন্য যে নির্মল পরিবেশ প্রয়োজন ই-বর্জ্যের কারণে তা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পৃথিবীর বুকে মানুষ ব্যাতীত অন্য কোনো প্রাণী ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র উৎপন্নও করে না ব্যবহারও করে না। প্রতিবছর ই-বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে ৩০ শতাংশ করে। ই-বর্জ্যের দূষণ যেন বাঁধাহীন সর্বজনীন। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়; সারা বিশ্বেই ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট মনিটর ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে প্রায় ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে। সংস্থাটির মতে, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ই-বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বব্যাপী ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাজারের আকার ছিল ৫২.৪৪ মিলিয়ন টন এবং ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ৫৪.৬৪ মিলিয়ন টন। ২০৩২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এটি ৬৯.৬৮ মিলিয়ন টনে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বে জ্যামিতিক হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে। ই-বর্জ্য সবচেয়ে বেশি জমা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহে অপর্যাপ্ত লোকবল, অর্থ, প্রযুক্তির কারণে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অতিশয় দুর্বল ও বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও পদ্ধতিগত এবং অবকাঠামো দুর্বলতায় এসব বর্জ্যের রিসাইক্লিং তেমন একটা হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক ৩ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়।

এর মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে আসে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন টন এবং বাকি অংশ (০.৬ মিলিয়ন টন) আসে নিজস্ব ইলেকট্রনিক্স ব্যবহারের ফলে। ২০৩৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এই পরিমাণ ৪.৬২ মিলিয়ন টনে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা বার্ষিক প্রায় ২০-৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর মাথাপিছু ই-বর্জ্য উৎপাদন ১.২ কেজি। প্রতিবছর দেশে মাত্র ১৩ হাজার ৩০০ টন ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং হয়। ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর ঝুঁকিও অনেক। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু মারা যায় ই-বর্জ্যের ক্ষতির কারণে এবং ৮৩ শতাংশ শিশুশ্রমিক দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রের কাছাকাছি বসবাসকারী ৩৬.৩ শতাংশ মহিলা মৃত্যুর শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ই-বর্জ্যের কারণে ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ই-বর্জ্যে যে ধাতব ও অধাতব উপাদানগুলো থাকে তা হলো, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রূপা, প্যালাডিয়াম, প্লাটিনাম, নিকেল, টিন, লেড (দস্তা), লোহা, সালফার, ফসফরাস, আর্সেনিক প্রভৃতি। পরিবেশের সঙ্গে এগুলো মিশে মানব শরীরে প্রবেশ করছে। যার ফলে মানব শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধছে। ই-বর্জ্যে থাকা অ্যান্টিমনি মৌলটির কারণে চোখ, ত্বক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের ক্ষতি হচ্ছে। আবার এই দ্রব্যের সঙ্গে থাকা বিসমাথ থেকে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের ক্ষতি, অনিদ্রা, হতাশা, হাড়ের যন্ত্রণা প্রভৃতি বাড়ছে। ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতু ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, পাকস্থলীর সমস্যা, আলসার, অ্যালার্জি প্রভৃতির জন্য দায়ী। অধিক মাত্রায় দেহে প্রবেশ করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কোবাল্ট থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও চোখ। থাইরয়েডের সমস্যা, অ্যাজমা প্রভৃতির জন্যও কোবাল্ট দায়ী। ই-বর্জ্যরে আরও একটি ক্ষতিকর উপাদান হলো মলিবডেনাম। এটির কারণে হাত, পা, হাঁটু, কনুই প্রভৃতি অঙ্গে ব্যথা সৃষ্টি হয়। বহু ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যে লেড বা সিসা ব্যবহৃত হয়। এই উপাদানটি জীবজগৎ ও পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। এই উপাদানটি কোনোভাবে মানবদেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক, কিডনি প্রভৃতির ক্ষতি হতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত