ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। কোরবানি ইসলামি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মহান ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে প্রতিবছর মুসলমানরা কোরবানি দেন। আর কোরবানির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত চামড়া শিল্প।
কোরবানি পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করা জায়েজ নয়। এটি সদকা কিংবা আল্লাহর রাস্তায় দান করার জন্য নির্ধারিত। গরিব-দুস্থ, মাদ্রাসা, এতিমখানা এবং কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা উত্তম। ইসলাম ধর্মে এটি সদকার অংশ হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবে এই সদকা অনেক সময় অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের স্বীকারে পরিণত হয়। বহুু যুগ ধরে চামড়া শিল্প আমাদের দেশের জন্য রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত। দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার বিরাট চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর বিদেশে চামড়া রপ্তানি করে সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিসটিকা ও রিচার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের তথ্য মতে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক চামড়া বাজারের আকার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫২ বিলিয়ন বা ৫২০০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। চামড়া শিল্পের উপর ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নয় লাখ লোক জীবিকা নির্বাহ করে। চামড়া শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে ২৩০টিরও বেশি ট্যানারি। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদের তথ্য অনুযায়ী এ বছর দেশে ১ কোটির বেশি পশু কোরবানি হয়েছে।
কোরবানির চামড়ার অর্থ বিলি-বণ্টন একটি ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব বটে। যুগ যুগ ধরে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো কোরবানির চামড়া বিক্রি করে মাদ্রাসার খরচ বহন করে। এলাকার গরিব মিসকিনরা কোরবানির ঈদ আসলে আশায় থাকে কোরবানির চামড়া বিক্রি হলে সেখান থেকে তারা কিছু অর্থ পাবে। কিন্তু বাজারে চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়ার বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। চামড়া ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা মিলে সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে দিচ্ছে। এ বছরও কোরবানির ঈদে চামড়া নিয়ে কারসাজি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার পূর্বের চামড়ার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। পূর্বে যে চামড়া ৪০০০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো সে চামড়া বিগত কয়েক বছর ধরে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২০০ টাকায়। পানির দামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। এ বছরও ২০০-৩০০ টাকার বেশি চামড়া বিক্রি করা যাচ্ছে না। সরকারের তরফ থেকে নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রির কথা বলা হলেও বাস্তবে বাজারে সেই দাম পাওয়া যায় না। স্থানীয় আড়তদার এবং ট্যানারি মালিকরা কারসাজি করে চামড়ার দাম কমিয়ে দেওয়ার কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কম দামে চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ সময় চামড়ার ন্যায্য দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে হয়। প্রতি বছর ঈদের পর প্রায় একই চিত্র দেখা যায়। চামড়া ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে না পারার দরুণ অধিকাংশ চামড়া রাস্তায় পড়ে থাকে। অনেক সময় চামড়া মাটিচাপা দিতে হয়, কখনও নষ্ট হয়ে যায় অযত্নে। এ বছর কোরবানির ঈদে চট্টগ্রামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে আতুড়ার ডিপো ও মুরাদপুরে হাজার হাজার চামড়া রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। আড়তদারদের কেউ চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। স্থানীয় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে না পেরে গাড়ি ভাড়া নিজ পকেট থেকে দিতে হচ্ছে।
বিগত সরকারের সময়ে সারা দেশে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ন্ত্রণ ছিল শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এলাকার দরিদ্র গরিব মিসকীন ও মাদ্রাসার এতিম ছাত্ররা। গরিবের হক মেরে চামড়ার শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন ব্যবসায়ী ও নেতাকর্মীরা। সংকটে ফেলেছেন দেশের চামড়া শিল্পকে। কোরবানির পশুর চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি আসলে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেন। বড় বড় ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পরে ট্যানারি মালিকরা নামে মাত্র মূল্যে কিনে নেয়। প্রত্যেক বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চামড়ার দাম নিয়ে দ্বিধায় থাকেন কোরবানিদাতা ও ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন, বিগত সিন্ডিকেটের পতনের পর নতুন করে সিন্ডিকেট হলে সংকটে পড়বে চামড়া শিল্প। তাই সঠিক তদারকির মাধ্যমে চামড়ার প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাজে লাগাতে হবে এবং কোরবানির চামড়া অবৈধ সিন্ডিকেটের হাতে যাতে যেতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কোরবানিদাতারা যেন চামড়ার ন্যায্য মূল্য পায় সেই উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। কোরবানিদাতারা চামড়ার ন্যায্য মূল্য পেলে গরিব দুঃখিরা তাদের ন্যায্য হক থেকে অন্যান্য বছরের মতো বঞ্চিত হবেন না।
বাংলাদেশে বহু ক্ষেত্রে কাঁচা চামড়া ভারতে পাচার হয়। ভারত ওই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে লাভবান হয়। অথচ বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার কোনো মূল্যই থাকে না। বাংলাদেশে অধিকাংশ কোরবানির চামড়া, এতিমখানা ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে দান করা হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরিচালনা ব্যয়ের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কোরবানির চামড়ার বিক্রয় মূল্য থেকে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে চামড়ার দাম আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করে। এই কমার পেছনে রাজনীতি রয়েছে বলে মনে করেন এদেশের ইসলামপন্থি বুদ্ধিজীবী ও ধর্মীয় মহল। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মাহামুদুল হাসান বলেন, চামড়ার দাম ধসে পড়া একটি পরিকল্পিত অপচেষ্টা। এর মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলোকে আর্থিকভাবে দুর্বল করা হচ্ছে। অনেক গবেষকরা মনে করেন, ধর্মীয় অনুদানের উৎসগুলোর কার্যক্রম একে একে বন্ধ করার কৌশল হিসেবে চামড়া বাজারে ধস নামানো হয়েছে।
লেখক : সংস্কারক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক