ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

একটি নিঃশব্দ চিঠি বাবার নামে

আসাদুজ্জামান খান মুকুল
একটি নিঃশব্দ চিঠি বাবার নামে

আমি যখন বিএসসি পাস করি, বাবা তখন জীবনের শেষ প্রান্তে। কখনও কল্পনাও করিনি জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের ঠিক পরেই জীবনের সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতির ভার কাঁধে তুলে নিতে হবে। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

আমার শিক্ষা ও জীবন গঠনের প্রতিটি ধাপে বাবার ছায়া ছিল অবিচল। নিজে খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি, তবু তার স্বপ্ন ছিল পাহাড়সম- সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলা। কৃষি ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বসবাস করায় চাষাবাদ প্রায়ই ব্যর্থ হতো, সংসার চলত টালমাটাল। এই দুঃসময়ে বাবা চুপিচুপি জমি বন্ধক রাখতেন কিংবা বিক্রি করতেন- শুধু আমার পড়াশোনা যেন থেমে না যায়। তখন তা জানতে পারিনি। অনেক পরে, যখন জীবন কিছুটা বোধগম্য হয়েছে, তখন বুঝতে পেরেছি তার সেই নিঃশব্দ সংগ্রাম কতটা গভীর, কতটা নিরবচ্ছিন্ন।

আমাদের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সাভার গ্রামের একপাশে- নিচু এলাকায়। বাবা ভোরে উঠে চলে যেতেন মাঠের কাজে- হাতে লাঙল, কাঁধে কষ্ট। কখনও কখনও বর্ষার দিনে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম- বাবা বৃষ্টির ধারা উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। ফিরেছেন ভেজা গা আর কাদামাখা পা নিয়ে। তখন বুঝিনি সেই পায়ের ছাপগুলোই আমার জীবনের মানচিত্র হয়ে উঠবে। শুধু দেখেছি- বাবা কী নিঃশব্দে সব সহ্য করে যাচ্ছেন- মাথানত না করে। বাবা খুবই সত্যবাদী মানুষ ছিলেন। কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি সত্য থেকে একচুল সরতেন না। অনেক সময় দেখেছি, সত্য বলার কারণে মানুষ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তবু তিনি কণ্ঠকে নরম রাখলেও মনটাকে কঠিন রেখেছেন নীতির প্রশ্নে। সেই সত্যের দীক্ষা নিয়ে আমিও আজ জীবন চলার পথে আছি। কখনও সহজ হয়নি পথটা; কিন্তু বাবার মতো মাথা উঁচু করে, সত্যকে ধারণ করে বাঁচার চেষ্টা করেছি প্রতিদিন। তার সেই নীতিবোধ যেন আমার রক্তে মিশে আছে- অদৃশ্য এক আলোর রেখার মতো, যা প্রতিটি সংকটে পথ দেখিয়ে দেয়।

আজ আমি একজন শিক্ষক। সমাজে একটি অবস্থান তৈরি করেছি। ছাত্রছাত্রীরা ভালোবাসে, সহকর্মীরা সম্মান করে, আশপাশের মানুষজনও আমাকে গ্রহণ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে ক্লাস শেষে যখন ফাঁকা বেঞ্চগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি- মনে হয়, বাবার মুখটা যেন ভেসে উঠছে কোথাও। মনে হয়- তিনি যদি একবার দেখতে পেতেন, তার সেই ছেলেটা ঠিক কেমন করে নিজের পথটা তৈরি করেছে। যে স্বপ্ন তিনি নিঃশব্দে বুনেছিলেন অন্তরের গহিনে- আজ তাই বাস্তব হয়েছে। কিন্তু তার চোখ তা দেখে যেতে পারেনি। এই অপূর্ণতার ক্ষরণ কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মাঝে মাঝে মনে হয়- জীবনে যত অর্জনই হোক, বাবার মুখে একফোঁটা হাসি দেখতে পারলে তবেই এই পাওয়া পরিপূর্ণ হতো। আজও যখন কোনো ছাত্রের চোখে হতাশা দেখি, বাবার কথা মনে পড়ে। যদি তিনি লড়ে না যেতেন, আমিও হয়তো হারিয়ে যেতাম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। তিনি ছিলেন আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক- শুধু পাঠ্যপুস্তকের নয়, জীবনের পাঠ শিখিয়েছিলেন তিনি। তার নীরবতা, আত্মত্যাগ আর সীমাহীন ভালোবাসা আমাকে আজও পথ দেখায়।

জীবনের প্রতিটি মোড়ে বাবার অভাব অনুভব করি- একটা হাত নেই, একটা ছায়া নেই, একটা ঘ্রাণ নেই। কেউ যখন বলে- ‘আপনি নিশ্চয়ই খুব গর্বিত আপনার অবস্থান নিয়ে?’ আমি শুধু মৃদু হাসি দিই। মনে মনে বলি- আমি গর্বিত নই, আমি ঋণী। একজন মানুষের প্রতি, যিনি নিজের স্বপ্নগুলো বিসর্জন দিয়ে আমার চলার পথ তৈরি করে গেছেন। বাবার মৃত্যু আমাকে আজও ব্যথিত করে। দীর্ঘদিন চিকিৎসারত অবস্থায় বিছানায় ছিলেন। আমি সবসময় তার পাশেই কাটাতাম। তাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মুহূর্তটি আমার চোখে স্পষ্ট।

মৃত্যু মুহূর্তে, নিঃশব্দে একটুকু শব্দ করে তিনি নিথর হয়ে পড়েন। তার চলে যাওয়ার পর বাড়ির আঙিনাটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল। বাজার থেকে ফিরে উঠোনে বসে এখন আর বিশ্রাম নেন না, নামাজ শেষে দোয়া করতে করতে দাঁড়িয়ে থাকেন না। আমি কোথাও গিয়ে ফিরতে দেরি হলে আর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকেন না। তার এই চুপচাপ উপস্থিতিই ছিল আমাদের জীবনের আড়ালে এক অদৃশ্য সুর। আজ এই অনুপস্থিতি সেই সুরকে রূপ দিয়েছে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাসে।

এই লেখাটি বাবার জন্য কিছুই নয়- শুধু তার স্মৃতির প্রতি আমার এক নিঃশব্দ চিঠি। এই চিঠির কোনো প্রাপক নেই, নেই কোনো ডাকঘরের ঠিকানা। আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস, এক অপূরণীয় শূন্যতা, আর অনন্ত কৃতজ্ঞতার ভার। এই শূন্যতার ভেতর দিয়েই আমি বেঁচে থাকি প্রতিটি মুহূর্তে তার উপস্থিতি অনুভব করি- কখনও ছাত্রদের চোখে, কখনও নিজের সংকটে, কখনও বাতাসে ভেসে আসা একটা পুরোনো ঘ্রাণে। মাঝে মাঝে মনে হয়- যদি একবার বলার সুযোগ পেতাম, ‘বাবা, তুমি যেভাবে নিঃশব্দে আমার পৃথিবী নির্মাণ করেছ, আমি প্রতিটি পদক্ষেপে তোমাকে বহন করি। তুমি বেঁচে থাকলে আজ সবকিছুই অন্যরকম হতো- তামার চোখে আমার সাফল্য দেখার যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাই আজও আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।

লেখক : শিক্ষকতা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নান্দাইল, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত