জ্ঞানচর্চা এবং এর লিখিত রূপের ইতিহাস মানব সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। কাদামাটির ফলক, প্যাপিরাসের স্ক্রল, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটাল জার্নাল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সহায়ক প্রকাশনা- এই যাত্রাপথ কেবল প্রযুক্তির উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক রূপান্তরেরও প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে, ‘পিয়ার-রিভিউড’ জার্নাল প্রবন্ধকে একাডেমিক মানদ- হিসেবে দেখা হলেও, এর ঐতিহাসিক শিকড় অনেক পুরোনো এবং বহুমাত্রিক।
প্রাচীন সভ্যতাগুলো যেমন মেসোপটেমিয়া, মিশর ও চীন জ্ঞান সংরক্ষণের প্রথম লিখিত রূপের সূচনা করে। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়রা কাদামাটির ফলকে আইন ও ধর্মীয় নিয়মাবলি কিউনিফর্ম লিপিতে লিখে রাখত। এগুলো মূলত প্রশাসনিক নথি ছিল এবং জনসাধারণের জন্য সহজে বোধগম্য ছিল না। প্রাচীন মিশরে ধর্মীয় মন্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র ও জ্যোতিষবিদ্যার প্রবন্ধ লেখা হতো প্যাপিরাসে, যা পুরোহিত ও অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই যুগে জ্ঞান ছিল নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার, বিতরণের বস্তু নয়। গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় দর্শনভিত্তিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটলে জ্ঞানচর্চায় যুক্তির বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ধারণা উপস্থাপন শুরু হয়। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হিপোক্রেটিস ও গ্যালেনের পাণ্ডুলিপিগুলো শিষ্য ও অনুগতদের মাধ্যমে অনুলিপি হয়ে প্রচারিত হতো। এখানে জ্ঞান সমালোচনামূলক আলোচনার উপাদান হিসেবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল। ইসলামী স্বর্ণযুগ (৮ম থেকে ১৪শ’ শতক) জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমাহ’ এবং কর্ডোভার বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রগুলোতে বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসা ও দর্শনে মৌলিক গবেষণা, অনুবাদ ও সংকলন হতো। আল-খোয়ারিজমি, ইবনে সিনা, আল-বিরুনি প্রমুখ পণ্ডিতদের রচনাগুলো হাতে লেখা কপি আকারে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই যুগেই টীকাভিত্তিক চর্চা এবং পূর্ববর্তী লেখকের চিন্তাধারার সঙ্গে নতুন ভাবনা যুক্ত করার প্রবণতা দেখা যায়, যা বর্তমান ‘সাইটেশন’-ভিত্তিক জ্ঞানচর্চার পূর্বসূরি। ১৫শ’ শতকে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার জ্ঞান পরিবেশনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। বই ছাপা সহজ ও দ্রুত হওয়ায় জ্ঞান প্রথমবারের মতো গণমানুষের নাগালে আসে। এটি ইউরোপে সংস্কার আন্দোলন, বিজ্ঞান বিপ্লব ও দার্শনিক পরিবর্তনের পথ সুগম করে। নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ বা ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ এর মতো মৌলিক গবেষণাকর্ম বই আকারে প্রকাশিত হয়ে সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তখন বই কেবল গবেষণার সংরক্ষণ নয়, বরং জ্ঞান বিতরণের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ১৬৬৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত ‘ফিলোসফিক্যাল ট্রানজ্যাকশনস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি’কে বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক জার্নাল হিসেবে ধরা হয়। এটি দ্রুত তথ্য প্রকাশ, সহকর্মীদের পর্যালোচনা এবং ধারাবাহিক আলোচনার সুযোগ তৈরি করে জ্ঞানচর্চাকে এক কাঠামোবদ্ধ ও ইনক্রিমেন্টাল রূপ দেয়। রবার্ট মার্টনের বিজ্ঞান সমাজতত্ত্বের তত্ত্ব অনুযায়ী, জার্নাল প্রবন্ধ ছিল ‘বিজ্ঞানের মানদ-’ (norms of science) যেমন সর্বজনীনতা, নিরপেক্ষতা, সংশয়বাদ ও সহযোগিতামূলকতার বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার। ১৯শ’ ও ২০শ’ শতাব্দীতে একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গবেষণা পদ্ধতি স্থায়িত্ব লাভ করে। গবেষণা ও শিক্ষার সংযুক্তি, জার্নাল-ভিত্তিক পদোন্নতি এবং ডিসিপ্লিনভিত্তিক বিভাজন জার্নাল প্রবন্ধকে কেন্দ্রীয় স্থান দেয়। একইসঙ্গে, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানে বই একটি প্রামাণ্য মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, যেখানে বৃহত্তর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সম্ভব হতো। ২১শ’ শতাব্দীতে ডিজিটাল রূপান্তর জ্ঞান প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ করে। ইন্টারনেটভিত্তিক জার্নাল, ওপেন অ্যাক্সেস মডেল, প্রি-প্রিন্ট সার্ভার (যেমন arXiv) এবং ইনস্টিটিউশনাল রিপোজিটরিগুলো জ্ঞান প্রচারের গতি ও পরিধি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে, বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সাবস্ক্রিপশন মডেল নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেমন বাংলাদেশে, সীমিত বাজেটের কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের জন্য এসব প্রবন্ধে প্রবেশাধিকার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে অনেক শিক্ষক শুধুমাত্র পদোন্নতির জন্য নিম্নমানের বা সন্দেহজনক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করছেন। এতে মৌলিক গবেষণার পরিবর্তে এক ধরনের ‘আউটপুট বান্ধব’ কার্যক্রম চলছে, যার বাস্তবসম্মত প্রভাব সামান্য। প্রবন্ধ তখন আর জ্ঞান-উৎপাদনের বাহন নয়, বরং এক ধরনের একাডেমিক ‘টোকেন’ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে গবেষণা প্রবন্ধ বা বই প্রকাশকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, একটি বিতর্কিত বিষয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এই প্রবণতা বেশ প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় গবেষণার প্রকৃত মান, সমাজে এর প্রয়োগযোগ্যতা বা জ্ঞানভিত্তিক প্রভাবের চেয়ে প্রকাশনার সংখ্যাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে একাডেমিক পরিমণ্ডলে ‘জানার জন্য লেখা’র পরিবর্তে ‘উন্নতির জন্য লেখা’ এক ধরনের প্রথাগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে। প্রকাশনা-সর্বস্ব এই প্রবণতার কারণ হিসেবে বলা হয়, শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং উন্নত হবে এবং শিক্ষকরা গবেষণায় আগ্রহী হবেন। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রকাশিত গবেষণার একটি বড় অংশই নিম্নমানের, অস্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত এবং প্রায়শই সমাজ বা নীতিনির্ধারকদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এই গবেষণাগুলো সাধারণত ইংরেজিতে রচিত হয়, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য বোধগম্য বা প্রযোজ্য নয়, ফলে জ্ঞানের আদান-প্রদানে একটি বড় বাধা সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গবেষণা প্রকাশনার পাশাপাশি মূল্যায়নের জন্য কঠোর মানদ- অনুসরণ করা হয়। সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধুমাত্র প্রকাশনা থাকলেই চলে না; গবেষণার প্রকৃত প্রভাব, তা কতবার উদ্ধৃত হয়েছে এবং কোন ধরনের নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেছে, তাও বিবেচনায় আসে। এর পাশাপাশি, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘থার্ড মিশন’ বা সমাজে অংশগ্রহণমূলক কাজকে গুরুত্ব দেয়। এর মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি প্রকল্প, পাবলিক পলিসিতে অবদান, বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন- যা একাডেমিয়ার বাইরের জগতে বাস্তব পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তাদের উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞান সৃষ্টি নয়, বরং সেই জ্ঞানকে সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করা। সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবারের আমলাতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকারিতার পরিবর্তে নিয়ম ও কাঠামোকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন মূল উদ্দেশ্য পূরণের চেয়ে প্রক্রিয়াকেই মুখ্য মনে করা হয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণা প্রকাশনা হয়ে উঠেছে একটি প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা (ritual), যার সঙ্গে জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ বা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক থাকে না। মিশেল ফুকোর ‘পাওয়ার/নলেজ’ ধারণা অনুযায়ী, একাডেমিক প্রকাশনার মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু এই ক্ষমতা যখন বাস্তব সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত না হয়ে শুধুমাত্র পদোন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন তা বিদ্যাচর্চা না হয়ে বাণিজ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশে এই চিত্র সুস্পষ্ট। ফিনল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পাশাপাশি বাস্তব জীবনে এর প্রভাবকেও মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়। যেমন: কোনো গবেষণা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে কি না, সরকারি নীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না, বা প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়েছে কিনা- এসব মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ব্যবধান আরও প্রকট। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ থেকে পদোন্নতি পর্যন্ত যে নীতিমালা রয়েছে, তা বহু পুরোনো এবং আন্তর্জাতিক মানদ- বিবেচনায় নেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা শুধুমাত্র নিজ উদ্যোগে গবেষণা করে থাকেন, কোনো ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় বা জাতীয় গবেষণা তহবিল থেকে সহায়তা পান না। ফলে গবেষণা হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন এবং কেবলমাত্র নিজস্ব পদের উন্নয়নের জন্য পরিচালিত এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা। এই ব্যবস্থার আরও একটি বড় ফাঁকফোর হলো—প্রকৃত মাঠ-সমীক্ষা ও ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ প্রায় অনুপস্থিত। গবেষকরা ক্ষেত্র বা কমিউনিটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে না তুলে কেবল ইন্টারনেট বা সেকেন্ডারি ডেটার উপর ভিত্তি করে গবেষণা পরিচালনা করেন। এর ফলে গবেষণা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সমাজে কার্যকর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়।
এই প্রকাশনা-সর্বস্ব সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি কার্যকর গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তোলা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অত্যাবশ্যক। এর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে: ১. গুণগত মূল্যায়ন ও নীতিমালায় পরিবর্তন: প্রমোশন নীতিমালায় শুধুমাত্র সংখ্যাগত বিবেচনা নয়, গুণগত মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে গবেষণার মান, মৌলিকত্ব এবং সমাজে এর প্রভাবের উপর জোর দেওয়া সম্ভব হবে। প্রকাশনার মানের পাশাপাশি এর সাইটেশন, সমাজে এর প্রভাব, নীতি নির্ধারণে এর ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ২. প্রায়োগিক গবেষণার উপর জোর: গবেষণাকে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা এবং কমিউনিটি সংগঠনগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা প্রকল্প হাতে নেওয়া। এতে গবেষণা হবে বাস্তবভিত্তিক এবং এর প্রয়োগ সমাজে দৃশ্যমান হবে। ‘অ্যাকশন রিসার্চ’ বা অংশগ্রহণমূলক গবেষণাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ৩. বহুমুখী মূল্যায়ন সূচক: গবেষণা মূল্যায়নে নতুন সূচক অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যেমন সামাজিক প্রভাব, নীতিনির্ধারণে অবদান, কিংবা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী প্রকল্পে নেতৃত্ব প্রদান। এছাড়াও, যারা একাডেমিক জগতে কর্মরত নন, এমন বিশেষজ্ঞদের (যেমন: শিল্পপতি, সরকারি নীতি নির্ধারক, এনজিও কর্মী) যুক্ত করে একটি বহুমাত্রিক গবেষণা পর্যালোচনা পদ্ধতি তৈরি করা যেতে পারে। ৪. তরুণ গবেষকদের জন্য প্রশিক্ষণ: পিএইচডি বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তরুণ গবেষকদের শুধু গবেষণা পদ্ধতি নয়, বরং কীভাবে গবেষণাকে সমাজে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়, কাদের সঙ্গে কাজ করলে বাস্তব পরিবর্তন আনা যায়, কীভাবে গবেষণার তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়- এসব কৌশল শেখানো জরুরি। ৫. আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোরও একটি বড় দায় রয়েছে। তারা যদি শুধু গবেষণা প্রকাশনা গ্রহণ না করে, বরং তার বাস্তব প্রভাব ও প্রয়োগকেও সমান গুরুত্ব দেয়, তাহলে অনেকাংশে এই একাডেমিক বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করা সম্ভব হবে। ৬. গবেষণার জন্য অর্থায়ন ও অবকাঠামো: বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং আধুনিক অবকাঠামোর অভাব একটি বড় সমস্যা। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) এ বিষয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে। ৭. আন্তঃবিভাগীয় ও বহু-বিষয়ক গবেষণা: শুধুমাত্র নিজ নিজ বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, আন্তঃবিভাগীয় (Interdisciplinary) এবং বহু-বিষয়ক (Multidisciplinary) গবেষণাকে উৎসাহিত করা উচিত। ৮. গবেষণার নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা: গবেষণায় নৈতিকতা বজায় রাখা এবং অ্যাকাডেমিক সততা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার মান, ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, এবং ফলাফল উপস্থাপনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত।
একাডেমিক প্রমোশনের জন্য গবেষণা প্রকাশনাকে একমাত্র মানদ- হিসেবে বিবেচনা করা একটি আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা। এটি এমন এক জ্ঞানের জগৎ সৃষ্টি করে, যা নিজের মধ্যেই বন্দি থাকে এবং সমাজে এর কোনো প্রভাব নেই। অথচ জ্ঞান সৃষ্টি ও তার ব্যবহার হওয়া উচিত মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার হাতিয়ার। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি এই প্রকাশনাকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে কার্যকর গবেষণার দিকে ধাবিত হয়, তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকার অর্থে সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হতে পারবে। তখন আর জ্ঞান হবে না শুধু পদের জন্য, জ্ঞান হবে মানুষের জন্য। এই রূপান্তর কেবল উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও সহায়ক হবে।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান (সাবেক), সমাজকর্ম বিভাগ, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও এমএসএস শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ