ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু : বাংলাদেশের সামরিক প্রস্তুতির সময়

রাজু আহমেদ
জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু : বাংলাদেশের সামরিক প্রস্তুতির সময়

আগামীর পৃথিবী যুদ্ধবাজদের। অন্তত আক্রমণকারী না হলেও প্রতিহত করার সক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে। সার্বভৌমত্ব রক্ষার কতখানি সক্ষমতা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আছে? খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকার হিসেবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও সমানভাবে বিবেচনার সময় এখন। শুধু স্থলে নয়, আকাশ ও নৌ-নিরাপত্তার চাদরে দেশকে মুড়ে রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা ব্যতীত রাতে শুতে যাওয়াও এই সময়ের প্রেক্ষাপটে আহাম্মকি। ১৯৭১ সালে প্রমাণ হয়েছিল ধর্মীয় পরিচয়ের মিল থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তান ভাই না হয়ে খুনি সেজেছিল। তখন দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব না থাকলে কী ঘটতে পারত, তা ২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারতকে বন্ধু ও সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ভাবলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের আচরণ চরমভাবে উগ্র ও একপেশে ছিল। ক্ষেত্রবিশেষে তারা এখনও অনমনীয়। সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের সঙ্গে উত্তেজনা দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। কাগজপত্রের হিসেবে সামরিক সক্ষমতায় মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। যদি দেশকে কোনো পক্ষের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়, তবে সামরিক বাহিনী দেশের জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে কি?

অন্তত সামরিক সরঞ্জাম, সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা, আধুনিক প্রযুক্তি, আকাশ সুরক্ষা, সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা কিংবা সীমান্ত প্রতিরোধের দিক থেকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশের সমপর্যায়ের নয়। সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ যুদ্ধের প্রচলিত নকশাই বদলে দিয়েছে। দুই হাজার মাইল দূর থেকে আক্রমণ চালিয়েও বিপক্ষকে নিখুঁতভাবে নির্মূল করার নজির মেলে। ফলে, এই সময়ের যুদ্ধে সীমান্তবর্তীরা নয়, শত্রু হাজার মাইল দূরেও থাকতে পারে। নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশকে কোনো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সন্ধি করা উচিত। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’- এই স্লোগান আসলে কারো অন্তরঙ্গ বন্ধু হতে দেয়নি বাংলাদেশকে। আমেরিকান ব্লক কিংবা রাশিয়ান ব্লকের কোনো না কোনো ছাদের নিচে দেশের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা সাজানো জরুরি। বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা টেকসই করতে না পারলে দেশের সম্পদণ্ডসমৃদ্ধির ওপর নানা সময়ে হরেক শকুনের নজর পড়বে। দুনিয়ায় সবার হয়ে থাকা যায় না; সবার হৃদয়ে থাকা যায়। বাংলাদেশ সবার বন্ধু সাজতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য শক্তিধর রাষ্ট্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের সম্পর্ক উপেক্ষা করে এক ব্যক্তি ও একটি দলের সমর্থনে গোটা ভূখণ্ডের বিরুদ্ধাচরণ করা যায় না। এটি কূটনৈতিক সদাচরণ নয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম বিশ্বব্যাপী। যাদের হয়ে তারা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করে, তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা কোনো দেশ বা গোষ্ঠীর সাধ্যে নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকার সামরিক বাহিনীকে দলীয় অ্যাজেন্ডায় ও বিদেশি প্রভাবের আওতায় আনার চেষ্টা করেছে। সীমান্তরক্ষীদের দায়িত্ব ছিল প্রতিবেশীর গুলিতে নিহত স্বদেশী মানুষের লাশ কুড়িয়ে আনা! এখন বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীকে আধুনিকায়ন করে বৃহৎ ও প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

বিশ্ববাসী ততই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। প্রতিবেশীদের চোখরাঙানি বন্ধ করতে কিংবা অন্যায়ের প্রতিবাদে সামরিক সক্ষমতা থাকা আবশ্যক। অস্ত্রের সমতাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিয়ামক। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান কিংবা উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়াসহ মিত্রদের স্বার্থরক্ষা সামরিক সক্ষমতার ফলাফল। পক্ষ-প্রতিপক্ষের অস্ত্র ভারসাম্য নিশ্চিত হলে বিশ্ব আরও কিছুদিন টিকবে।

আজ যদি ইসরায়েলের পার্শ্ববর্তী কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের কাছে ইসরায়েল-সমকক্ষ সামরিক শক্তি থাকত, তবে ইসরায়েলের মতো সভ্য রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আর একটিও থাকত না। অথচ সেটেলাররা গৃহস্থদের ওপর আজ কী মাতব্বরি করছে! দুনিয়াটাই শক্তের ভক্ত এবং নরমের জম। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আধুনিকায়নে মনোযোগী হতে হবে। আজ কেউ বন্ধু ও চিরকাল মিত্র থাকবে- এমন ধারণায় পৃথিবী চলে না। সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।

রাফাল বাংলাদেশের দরকার। বাসস্থানের মতো মিগের প্রয়োজন। মিসাইল আমাদেরও থাকা উচিত। আয়রন ডোম ফিট করতে পারে এমন দেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের প্রয়োজনে খাতির করতে হবে।

অস্ত্র থাকা মানে শুধু ব্যবহার নয়, অন্যের অস্ত্রকে কোষবদ্ধ রাখার নিশ্চয়তাও। যদি কোনো কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলো বাংলাদেশকে এমন দিক থেকে চাপ দেয়, তাহলে আমাদের সামরিক সরঞ্জাম ও বাহিনী দেশের সুরক্ষা দিতে পারবে কি? কারো কাছে নত হয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায় না।

যে নৈতিকতা ও মানবিকতার মূল্যবোধ একসময় পৃথিবী পরিচালিত করত, তা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখন জোর যার, মুল্লুক তার। মানুষ এখন যন্ত্র; যারা যুদ্ধের হুকুম দেয়, তারা দানব। নারী ও শিশু, বেসামরিক মানুষ মারার খেলায় কেউ মাতোয়ারা হতে পারে না। দেশের মানুষ ও মানচিত্র সুরক্ষায় সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এখন আশু প্রয়োজন। তলোয়ারের বিরুদ্ধে তসবি কিংবা মিসাইলের মোকাবেলায় হুংকার দেওয়া পাগলের প্রলাপ। বাস্তববাদী চিন্তা করা দরকার।

দেশের মেধাবী বিজ্ঞানীদের সামরিক শক্তির সমৃদ্ধিতে নিয়োজিত করতে হবে। এপিজে আবুল কালামকে ভারত শিক্ষা বা সংস্কৃতিমন্ত্রী বানায়নি—তাকে ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সেখানে সফলতার স্বীকৃতিতে মৃত্যুপ্রায় অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ যেন বাস্তবতা উপলব্ধিতে দেরি না করে। বোমা কোথাও ফুল হয়ে ফুটবে না; বারুদ বাতাসের কাছেও রক্ত চায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত