ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আজকের চারাগাছ আগামীর সঞ্চয়

এমরান চৌধুরী
আজকের চারাগাছ আগামীর সঞ্চয়

সারা পৃথিবীর জলবায়ুর এখন ব্যাপক আকারে পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কম আয়তন অথচ বেশি মানুষের দেশগুলো। এসব দেশ বা অঞ্চলগুলোতে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য আবাসন এবং রাস্তাঘাট তৈরির জন্য নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। বনজঙ্গল কেটে সমতল করা হচ্ছে পাহাড়। পুকুর-জলাশয়, দিঘি ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। শহর এলাকায় গড়ে উঠছে অতিকায় দৈত্যের মতো বড় বড় ফ্লাটবাড়ি। এটা অনেকটা সুখকে তাড়িয়ে অসুখ কেনার মতো। খালি জায়গা যত বেশি কমবে তত বেশি হবে বায়ু, শব্দ ও পরিবেশ দূষণ। আমরা যেন বিষয়টি জেনেও বুঝতে চাই না। আলীশান ঘরবাড়ি বানিয়ে বায়ু চলাচলের পথ সীমিত করা মানে নিজেকে ঝুঁকির মুখে নিয়ে আসে। একেই বলে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। এভাবে বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ফলে আবহাওয়ার যে স্বাভাবিক আচরণ হওয়ার কথা তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আবহাওয়ার বৈরী আচরণের ফলে অনেক দেশই এখন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের অশনি সংকেত মাথায় নিয়ে কালাতিপাত করছে। আমরা জানি, সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। তা না করলে সেই কাজটি আর সঠিকভাবে করা হয়ে ওঠে না। ঠিক তেমনি, বৃষ্টির সময় বৃষ্টি আর শীতের সময় শীত পড়তে হয়। তা না হলে দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণের অনেকগুলো কারণের একটি ক্রমাগত বনভূমি উজাড় তথা গাছপালা কমে যাওয়া। আজ থেকে শতবর্ষ আগে আমাদের দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশই বনভূমি ছিল। বড় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় নির্বিচারে গাছপালা কাটা, আর এক শ্রেণির মানুষের অর্থ লিপ্সা আর কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে এই অমূল্য ও অপরিহার্য বনভূমি বর্তমানে ৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এসব মানুষ এদেশের বিভিন্ন অংশে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। এদের দ্বারা বিপন্ন হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উপজেলার বনাঞ্চল। এমনকি সমতলভূমির বিশাল এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এদের কর্মকাণ্ডে। জেনে রাখা দরকার, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। আর এভাবে বনভূমি উজাড় হতে থাকলে, গাছ না লাগিয়ে অবাধে গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নয় যে দিন আমাদের বনভূমি এসে দাঁড়াবে ২/৩ শতাংশে। এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখনই ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি গাছ লাগাতে হবে। মানব জীবনে বৃক্ষের মতো উপকারী বন্ধু আর দ্বিতীয়টি নেই। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোটে না, বৃক্ষও তেমনি। বৃক্ষ আমাদের খাদ্য দেয়, বস্ত্র দেয়, ছায়া দেয়, আশ্রয় দেয় সর্বোপরি আমাদের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান সরবরাহ করে। প্রত্যেক প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য বৃক্ষ আবশ্যকীয়। বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন দেয়। সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। আমরা নিঃশ্বাস ফেলার সময় যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি তা বৃক্ষ প্রকৃতির কাছ থেকে শোষণ করে নেয়। বিনিময়ে আমাদের দেয় অক্সিজেন। বৃক্ষ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ না করলে বাতাস বিষাক্ত হয়ে যেত। প্রাণিমাত্রই বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ত। একটি বৃক্ষ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এটি আল্লাহ পাকের সুন্দর ব্যবস্থাপনা। তিনিই এভাবে বৃক্ষের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেন। চারিদিক সতেজ-সজীব গতিময় রাখেন। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এর পর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের কাছে ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান। তখন তারা আনন্দিত হয়। (সুরা রুম, আয়াত: ৪৩)। এক সময় ছিল উদ্ভিদকে মনে করা হতো প্রাণহীন। বিজ্ঞান গাছপালার প্রাণ আবিষ্কার করেছে বেশিদিন হয়নি। কিন্তু ইসলাম বলেছে, গাছের শুধু প্রাণ নয় অনুভূতি আছে, দায়িত্ববোধও আছে। এমনকি মহান আল্লাহকে বৃক্ষ সেজদা করে। তার তাসবিহ পাঠ করে। কোরআন পাকে ঘোষিত হয়েছে, ‘আপনি কি দেখেননি নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতমালা বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ আল্লাহকে সেজদা করে।’ (সুরা হজ, আয়াত-১৮)। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীজগত বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ তাদের খাদ্যের যোগান দিয়ে পৃথিবীর আলো বাতাসে বিচরণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো প্রাণীই শর্করা জাতীয় খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। শর্করা ভেঙে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তার সাহায্যে আমরা চলাফেরা করি। এক বিশেষ পদ্ধতিতে সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে বৃক্ষ এই খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ক্লোরোফিল নামের এক ধরনের সবুজ জিনিস। আর এই জিনিস থাকে গাছের সবুজ পাতায়। পৃথিবীতে যদি বৃক্ষ না থাকত তাহলে সেই কবে প্রাণী জগত বিলুপ্ত হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, বৃক্ষ পৃথিবীকে নানাভাবে বসবাসের উপযোগী করে রেখেছে। যেখানে বৃক্ষ নেই, সেখানেই সৃষ্টি হয় মরুভূমির। আর মরুভূমিতে বসবাস যে কতো দুর্ভোগ আর কষ্টের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তাই, আসুন গাছ লাগাই। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, সর্বোপরি পরিবেশের জন্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী বিনিমার্ণের জন্য। বৃক্ষ আপনার আমার আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতে বিমা বা সঞ্চয়। আজকের পাঁচ টাকার চারা গাছটি ভবিষ্যতে লক্ষ টাকার যোগানদার। শুধু তাই নয়, বৃক্ষরোপণ একটি সওয়াবের কাজ। সব ধর্মগ্রন্থে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বৃক্ষের ফল যতদিন পর্যন্ত মানুষ বা পশু পাখি খাবে, তার জন্য বৃক্ষ রোপণকারীর সওয়াব জমা হতে থাকবে আল্লাহর দরবারে। বৃক্ষের সবুজ শোভা শুধু সৌন্দর্যই বর্ধন করে না আমাদের স্বাস্থ্য ও চরিত্রে প্রভাব ফেলে। ফলে আমরা মানুষের প্রতি দয়াশীল হই। ভালোবাসতে শিখি। আজ তাই জাতীয় কবির অপরূপ রূপের বঙ্গজননীকে নতুন করে দেখার জন্য প্রত্যেকের উচিত একটা করে গাছ লাগান। আর তাতেই আমাদের প্রিয় দেশ সবুজের শোভায় ভরে উঠবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত