মানবতা হলো- একটি দার্শনিক ও নৈতিক চিন্তাধারা যা মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সমানাধিকার এবং কল্যাণকে কেন্দ্রে রেখে বিকশিত। এটি ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে ‘সকল মানুষের সার্বিক উন্নতি ও মুক্তির’ ওপর জোর দেয়। মানবতাবাদের মূল কথা হলো- ‘মানুষই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মানুষের সৃজনশীলতা, যুক্তিবাদ ও সহমর্মিতার মাধ্যমেই সমাজের শাসন সম্ভব।’ মানবতাবাদ কোনো স্বপ্ন নয়, এটি একটি প্রয়োজনীয়তা, যদি আমরা মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে চাই। বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদ, এই শব্দটি যখন উচ্চারিত হয়, তখন যে কটি নাম প্রথমে আসে, তার মধ্যে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম। যদিও তার পরিচয় বহুমাত্রিক, তিনি বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি দ্রোহের কবি, তবে নজরুলের অন্তর সত্তার গভীরে ছিল এক সুদৃঢ় মানবতাবাদী দর্শন, যা বিশেষত মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত হয় এক অসাধারণ স্পষ্টতায়।
তার কবিতায় মুসলিম সমাজই নয়, সমগ্র মানবতার মুক্তির বার্তা ধ্বনিত হয়েছে। নারীমুক্তি ও সমাজের পশ্চাৎপদতা নারীদের কথা- ‘নারীর অধিকার’ ‘বিদ্রোহিণী’ ‘খাতুন’ ইত্যাদি কবিতায় বলেছেন। যা আজও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এখনও অনেক মুসলিম পরিবারে নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতা ও সমঅধিকার নিয়ে রক্ষণশীলতা রয়েছে। নজরুলের চিন্তা এই ক্ষেত্রে এক প্রগতিশীল মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। নারীদের ঘুমিয়ে থাকা সম্ভাবনার জাগরণ চেয়েছেন। যেমন ‘খাতুন’ কবিতায় তিনি বলেন : ধর্মে যদি চোখ রাঙাও, নারীকে করো দাসী, সে ধর্ম নয় ধর্মান্ধতা, সে তো পশুর বাসি। এই কবিতা মুসলিম নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের দাবি তোলে, যা আজও বিস্ময়করভাবে প্রাসঙ্গিক।
২১ শতকে এসেও অনেক মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য, শিক্ষা-অধিকার হরণ, বোরকা চাপিয়ে মৌনতার সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয় ধর্মের নামে। নজরুল সেই যুগে দাঁড়িয়ে বলে গিয়েছিলেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ (কবিতা : নারী) এই ছিল নজরুলের ইসলাম, যেখানে নারী-পুরুষ সমান, যেখানে ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো- করুণা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ধৈর্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করা। তবে নজরুল শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন এক রেনেসাঁস-পুরুষ। ‘মহররম’, ‘কবির লাশ’, ‘কাফের’, ‘আল্লাহর ওপর ভরসা কর’- এসব কবিতায় নজরুল চেয়েছেন এক নবজাগরণশীল, মুক্তবুদ্ধির মুসলিম সমাজ, যে সমাজ কোরআনের মর্ম বুঝে, জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী হয়, যে নিজে সমাজের-দায়বদ্ধতা বোঝে, সেই মোতাবেক জীবনযাপন করে।
‘কাফের’ কবিতায় নজরুল ঘোষণা করেন : ‘আমি বিদ্রোহ করি, আমি মানুষকে ভালোবাসি। ধর্ম যার যার, মানবতা সবার।’ এই মনোভাব থেকেই তিনি ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণতাকে কোরআনের মর্মবাণীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নজরুলের এইম মানবতাবাদী আহ্বান আজ কতটা ফলপ্রসূ। উত্তরটি সহজ নয়, বরং দ্বিমুখী। একদিকে, নজরুলের রচনাগুলো পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে, মঞ্চে, গানে, বক্তৃতায় উচ্চারিত হচ্ছে, এ যেন তার উপস্থিতির এক বাহ্যিক স্বীকৃতি। তবে এই ‘উচ্চারণ’ কতটা অন্তর্গত চর্চায় পরিণত হয়েছে, সেটাই বাস্তবে যেটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে আর চর্চা হয় কতটুকু। বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজ আজ দুই বিপরীত মুখোমুখি বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছে। একদিকে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, নারী দমন, বিজ্ঞান বিমুখতা, অপরপক্ষের প্রতি অসহিষ্ণুতা, যা ইসলামকে একটি ভয়াবহ রূপে উপস্থাপন করছে। অপরদিকে, এক অংশের আলোকিত মুসলিম সমাজ একে প্রশ্ন করছে, সংস্কার চাইছে, মানবতা শেকড়ে ফিরে যেতে চায়। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, নারীবিরোধী ফতোয়া, কিংবা সামাজিক মিডিয়ায় ভিন্নমতের বিরুদ্ধে ঘৃণা নজরুলের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। যা সুশীল সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা অথচ নজরুল লিখেছিলেন : ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের তরে প্রেমের তরে করুণার তরে বিদ্রোহ হোক।’ এই বিদ্রোহ ছিল শুদ্ধতার, মানবতার পক্ষে এক অকুতোভয় উচ্চারণ।
নজরুল চেয়েছিলেন এমন এক মুসলিম জাতি, যারা কোরআনের ‘লা ইকরাহা ফিদ্দিন’ অর্থাৎ ধর্মে জোর-জবরদস্তি নেই, এই নীতিকে হৃদয়ে ধারণ করবে, প্রতিটি মুসলিম প্রাণ মানব জাতি। নজরুলের মানবতাবাদ পুনরাবিষ্কারের আহ্বান জানানো হচ্ছে মানুষের কল্যাণে। আজ যখন বিশ্বজুড়ে বিভাজন বাড়ছে, ধর্মের নামে যুদ্ধ ও বিদ্বেষ বাড়ছে, তখন নজরুলের কবিতা যেন আমাদের দ্বিতীয় কোরআন হয়ে ওঠে, মানবতার কোরআন। তার কণ্ঠ যেন কোরআনের করুণার সুরে উচ্চারিত এক কবিতার মতো : ‘দিল না হলো যদি পাক, তবে নামাজে কি হইবে কাজ? হৃদয় পাষাণ হলে তবে রোজা রাখার কী দরকার?’ এত স্পষ্টভাবে শুদ্ধ বাংলায় নজরুল ধর্মীয় অনুশাসন, অনুশীলনের কথা বলেছেন তারপরও এই প্রশ্নগুলো মুসলিম সমাজকে আজও জিজ্ঞেস করতে হয়, সাহস করে।
কাজী নজরুল ইসলামের মানবতাবাদী কবিতাগুলো আজও সমানভাবে ফলপ্রসূ, যদি আমরা তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করি। সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতন, শ্রেণি শোষণ ও ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তার কবিতা এক শাণিত অস্ত্র। প্রয়োজন শুধু সচেতন প্রয়োগ। নজরুল শুধু মুসলিম জাতির নন, তিনি বিশ্বমানবতার কবি, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাকে পড়তে হবে এবং তার উত্তরাধিকারকে প্রাসঙ্গিক রাখতে হবে। চল; চল; চল; ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল-নিম্নে উতলা ধরণি, তরঙ্গ অগণন! নজরুলের এই গতিময় আহ্বান আজও আমাদের সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত করে। শুধু ‘বিদ্রোহী’ নয়, নজরুলের ‘খাতুন’ ‘নারী’ ‘আমার কৈফিয়ত’ ‘কাফের’ ‘মহররম’ ইত্যাদি রচনাকে পাঠ করে যদি আমরা আমাদের সমাজ ও মননে প্রশ্ন তুলতে পারি, তবেই তার মানবতাবাদ সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ হবে। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে নির্দেশমূলক আওয়াজ তুলতে হবে, তবেই নজরুলের মানবতাবাদ পুনরুদ্ধার সম্ভব।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট