ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অর্থনৈতিক সংকট

মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে

মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে

দেশের অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয় বললেও কম বলা হয়। পতিত ও বিতাড়িত স্বৈরাচার অর্থনীতিকে শেষ করে দিয়ে গেছে। তার সাড়ে ১৫ বছরের লাগাতার অর্থ লুট ও পাচার অর্থনীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা কল্পনারও অতীত। ব্যাংক, শিল্প, বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স- কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সুখবর ছিল না। অর্থনীতির এই বেহাল প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তার ক্ষমতাকাল ১০ মাস পেরিয়ে ১১ মাসে পড়েছে। অথচ, এতটা সময় অতিবাহিত হলেও অর্থনীতিতে সুবাতাস প্রবাহিত হয়নি। অর্থনীতি পুনর্গঠন ও চাঙ্গা করার জরুরি তাকিদ অনুভূত হলেও সরকারের উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্য নেই। ক্ষেত্র বিশেষে বরং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়েছে। ভুলনীতি অনুসরণের কারণে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মচারী বেকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কর্মাভাব ও মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য বাড়িয়েছে। ঘটা করে বিনিয়োগ সম্মেলন করা হয়েছে। তাতে তেমন কোনো সুফল আসেনি। শিল্প-কারখানা স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না আসায় রাজস্ব আদায় কমেছে। শিল্প-কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের কর-শুল্ক দেওয়ার সক্ষমতা কমেছে। একদিকে ব্যাংকের ঋণ, অন্যদিকে শিল্প-ব্যবসা ঠিকমতো না চলার কারণে তারা মারাত্মক বিপাকে পতিত হয়েছে। এর বাইরে হাজার হাজার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। যাদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে, তারা শিল্প-ব্যবসায়ে তা কাজে লাগাতে পারছে না। এর গ্রহণযোগ্য একটা সুরাহা হওয়া দরকার ছিল। ওদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ভয়াবহ। শিল্প-কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবাহের শর্তে অতিরিক্ত মূল্য দিতে রাজি হলে পতিত সরকার যেমন, তেমনি বর্তমান সরকারও গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারেনি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শিল্প-কারখানা চালানো ও ব্যবসা-বাণিজ্য করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে খোলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। স্বৈরাচারের আমলে নেয়া লুটপাটেই ঋণ ও গোপন ঋণ যেমন খেলাপি হচ্ছে, তেমনি এখনও নানা কারণে ঋণখেলাপি হচ্ছে। ঋণখেলাপি কমানোর কোনো পদক্ষেপ সরকার নিতে পারেনি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লুটপাট ও পাচারের যে ‘সংস্কৃতি’ গড়ে উঠেছিল, এখন তা নেই বটে, তবে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে গৃহীত উদ্যোগে কোনো সুখবর নেই। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে অনেক লম্বা লম্বা কথা সরকারের তরফে বলা হয়েছে, কিন্তু ফল এ পর্যন্ত শূন্য। এখন পাচারকারী ধনকুবেরদের সঙ্গে সমঝোত করার নাকি চেষ্টা চলছে। এ চেষ্টাও কতদূর কী হবে, বলার উপায় নেই।

অর্থমন্ত্রণালয় আগামীতে, বিশেষ করে ২০২৬ সালে অর্থনীতিতে সম্ভাব্য কয়েকটি প্রধান চ্যালেঞ্জের বিষয় উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে উচ্চমূল্যস্ফীতি, ট্রাম্প ট্যারিফ, নিম্ন ট্যাক্স জিডিপি রেসিয়ো, দুর্বল আর্থিক সেক্টর, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী পরিস্থিতি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এরইমধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাড়ার আশঙ্কা বিদ্যমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্কনীতি নিয়েছেন, তাতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকপণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে রপ্তানি কমলে কিংবা শুল্কচাপ বাড়লে রপ্তানি আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাড়লেও এখন এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এ আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এরইমধ্যে খবর পাওয়া গেছে, এ যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে দাম আরও বাড়বে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিনা উসকানিতে ইসরায়েল ইরানে যে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে এবং অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে, তার জবাবে ইরানও ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে এবং এতে ইসরাইলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কতিপয় পশ্চিমা দেশ যুদ্ধবন্ধের বিষয়ে চেষ্টা শুরু করেছে। তাদের চেষ্টা সফল না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে, এমন ধারণাই স্বাভাবিক। একথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়, বিশ্বব্যাপী তেল-বাণিজ্যে সুয়েজ খাল ও হরমুজ প্রণালী গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে খ্যাত। ইরান এ দুটি পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। এ নিয়ে ইরান চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। যদি তেমন কিছু হয় কিংবা ওই পথ দুটি যুদ্ধের কারণে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে, তবে তেল পরিবহন কমে বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়া অসম্ভব নয়। বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের শতভাগ আমদানি করে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকেই এই আমদানি হয়ে থাকে। আমদানি ব্যাহত বা বাধাগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তেলের সংকট ও দাম বাড়লে পরিবহন ও উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরাসরি এবং অন্য অনেক ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে।

আমাদের গার্মেন্ট খাতের পরেই আছে আবাসন খাত। এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান আছে। আছে এর অনুসঙ্গী শিল্প-কারখানা। এসব খাতেও বিপুল বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, জনসেবামুখী এই আবাসন খাতের অবস্থা এখন অত্যন্ত বিপর্যয়কর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। নির্মাণ উপকরণ যেমন- ইট, রড, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদির দাম ক্রমবর্ধমান। জমি, প্লট ও ফ্ল্যাটের দাম এত বেশি যে, নিম্ন আয়ের তো দূরের কথা, মাধ্যম আয়ের কোনো ব্যক্তির পক্ষেও একটি ফ্ল্যাট কেনা অসম্ভবপ্রায়। বেসরকারি আবাসন খাতে প্রচুর রেডি ফ্ল্যাট থাকলেও তার বিক্রীতে চলছে চরম মন্দা। ব্যবসায়ীরা এমতাবস্থায়, ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতটির উদ্ধারে সরকারের কোনো গরজ ও পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আবাসন খাতের মতেই পোল্ট্রিও গণমুখী একটি খাত। বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতটি শুরু থেকে নানা সংকট-সমস্যা ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের শিকার। এর যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না। সর্ব শ্রেণির মানুষের সস্তায় আমিষের জোগান দেয় যে খাত, যে খাতে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য উদ্যোক্তা ও কর্মীর কর্মসংস্থান, সে খাতের প্রতি এই অবহেলা কেন? পোল্ট্রি খাতে যতটা অগ্রগতি হয়েছে তা ব্যক্তিক প্রচেষ্টার ফল। এ ব্যাপারে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। আবাসন ও পল্ট্রি খাতের মতো দেশে আরও নানা খাত রয়েছে, যা অর্থনীতি মজবুত ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের এ দিকে গুরুত্ব দিয়ে নজর দেওয়া দরকার। কথায় বলে: ‘রাই কুড়াতে কুড়াতে বেল’। অর্থনীতির সমস্ত উদ্যোগ একসঙ্গে, এক জায়গায় সংঘবদ্ধ করা গেলে সামগ্রিক অর্থনীতির যেমন উন্নতি ও বিকাশ ঘটবে, তেমনি অর্থনীতির ওপর আপতিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাও সহজ হবে। অর্থনীতির বিরাজমান সংকট উত্তরণ এবং বিকাশে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগের বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত