প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার ব্যয় হয় বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা মোতায়েন হন, সবকিছুই নাকি নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে। কিন্তু এই বিশ্বব্যাপী উদ্যোগের মাঝেও একটি ভয়াবহ ব্যতিক্রম সব সময়ই নজর এড়িয়ে যায় তাহলো- ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ। কেন?
ইসরায়েলের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক ধারণা থাকলেও, বিশ্ব এতে অদ্ভুতভাবে নীরব। যেখানে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো শুধু পারমাণবিক কর্মসূচির সন্দেহেই নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে পড়ে, সেখানে ইসরায়েলকে নির্বিঘ্নে এড়িয়ে চলে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের নেতৃত্বে গঠিত বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ কাঠামো আইনের চোখে সমতার কথা বললেও, ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ নীতির ভয়াবহ দ্বৈতনীতি প্রকাশ পায়, যা শুধু এই ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনাকেও বিপন্ন করে তোলে।
ইসরায়েলের পারমাণবিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায়, যখন গঠিত হয়েছিল ইসরায়েলি পারমাণবিক শক্তি কমিশন। এরপর অতি গোপনে এটি রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচিতে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তায় ইসরায়েল দক্ষিণ নেগেভ মরুভূমিতে নির্মাণ করে ডিমোনা পারমাণবিক চুল্লি। ১৯৬০-এর দশকের শেষ নাগাদ অনেক বিশেষজ্ঞই ধারণা করেন, ইসরায়েল এরমধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে।
১৯৮৬ সালে এই গোপন কর্মসূচির প্রথম বড়সড় তথ্য ফাঁস করেন ডিমোনা কেন্দ্রে কর্মরত সাবেক প্রকৌশলী মরদেখাই ভানুনু। তিনি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দেন। এর পরপরই তাকে মোসাদ অপহরণ করে রোম থেকে গোপনে ইসরায়েলে নিয়ে আসে, প্রহসনের বিচারে তাকে গোপনে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যার ১১ বছর কাটাতে হয় নির্জন সেলে। এই ঘটনা ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের পারমাণবিক গোপনীয়তায় একটি ফাটল সৃষ্টি করেছিল এবং বহু গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহকে সত্যে রূপ দিয়েছিল।
ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকার করেনি যে তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী। কিন্তু স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর মতে, ইসরায়েলের হাতে আনুমানিক ৮০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যার মধ্যে গ্র্যাভিটি বোমা, ভূমি, আকাশ ও সমুদ্রপথে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের ফেডারেশনও এই তথ্য সমর্থন করে জানায়, ইসরায়েলের কাছে রয়েছে সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র যা তাকে দ্বিতীয় দফার পারমাণবিক প্রতিঘাত বা ‘সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’ নিশ্চিত করে। এমনকি কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েল থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র উন্নয়নের পথেও অগ্রসর হচ্ছে।
এই অনানুষ্ঠানিক অথচ সুদূরপ্রসারী পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার একপ্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’। অথচ, ইরানের প্রতিটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর তীব্র নজরদারির আওতায় পড়ে, সেখানে ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার রয়ে যায় অন্ধকারে।
ইসরায়েলের পারমাণবিক নীরবতা শুধু একটি অভ্যন্তরীণ নীতি নয়; বরং এটি এক দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক দ্বৈত মানদ- দ্বারা সমর্থিত, যদি না বলা হয় নিয়ন্ত্রিত। পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে বৈশ্বিক চুক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-র দিকে তাকালে দেখা যায়, ইসরায়েল এই চুক্তিতে কখনোই স্বাক্ষর করেনি। এই চুক্তির বিধান অনুসারে, ১৯৬৭ সালের আগে যারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল না, তাদের জন্য এমন অস্ত্র তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি ইসরায়েল এই চুক্তিতে যোগ দিত, তবে তাকে নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য করা হতো। কিন্তু চুক্তির বাইরে থেকে, ইসরায়েল তার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পেরেছে অন্যদিকে, বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে মেনে চলতে।
এই বৈপরীত্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন ইরানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ইরান হলো একটি স্বাক্ষরকারী দেশ, যারা আইএইএ’র নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় রয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে তাদের কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছে। তবুও, ইরান নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বশেষে ইসরায়েলি বাহিনীর অবৈধ সামরিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছে। অপরদিকে, ইসরায়েল পায় বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মার্কিন সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সুরক্ষা।
এই পক্ষপাতদুষ্ট নীতির শেকড় নিহিত ১৯৬৯ সালের এক গোপন চুক্তিতে, যা হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোলদা মেয়ারের মধ্যে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র রাখবে, তবে তা নিয়ে কোনো ঘোষণা বা পরীক্ষা চালাবে না। এরপর থেকে একের পর এক মার্কিন প্রশাসন এই নীতির প্রতি অন্ধ দৃষ্টিপাত করেছে যা অন্য কোনো রাষ্ট্র করলে তা হতো আন্তর্জাতিক মানদ-ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ইসরায়েলের মিত্ররা যুক্তি দেন, শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তার পারমাণবিক প্রতিরোধব্যবস্থা বৈধ। কিন্তু যদি নিরাপত্তাহীনতা কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বৈধতা দেয়, তবে বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থা অর্থহীন। তাহলে একই যুক্তি কেন তেহরান, রিয়াদ বা কায়রোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না?
এই নীরবতা শুধু নৈতিক দ্ব্যর্থতা সৃষ্টি করে না, বরং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থার গোড়ার ভিতটাই দুর্বল করে দেয়। এনটিপি একটি নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো যারা পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করে, তারা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি পাবে এবং যারা অস্ত্রধারী, তারা ধীরে ধীরে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুত থাকবে। কিন্তু যখন একটি দেশ স্থায়ীভাবে এই নিয়মের বাইরে থাকে, তখন অন্যদের এই ব্যবস্থায় আস্থা হারায়। তাহলে ইরান বা সৌদি আরব নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে কেন, যদি ইসরায়েলের পারমাণবিক একাধিপত্য মেনে নেওয়া এবং রক্ষা করা হয়?
এই বোধের অনুপস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। সৌদি আরব এরমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে তারাও একই পথে হাঁটবে। মিসরও ইসরায়েলের গোপনতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতির অভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যা বারবার ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
ফলে, গোটা অঞ্চল এখন বিপজ্জনক এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এক মধ্যপ্রাচ্য যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র এবং পারস্পরিক বিশ্বাস দুর্লভ যা একটি বিপর্যয়ের অব্যর্থ সুযোগ। দুর্ঘটনাজনিত উত্তেজনা, ভুল হিসাব, কিংবা সাইবার হামলার মাধ্যমে শুরু হওয়া সংঘর্ষ সহজেই ভয়াবহ পরিণতিতে পৌঁছাতে পারে।
এখানে রয়েছে নৈতিক মাত্রাও। ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডারকে উপেক্ষা করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একরকমভাবে এমন এক বিশ্বকে বৈধতা দেয়, যেখানে কিছু দেশ গণবিধ্বংসী অস্ত্র রাখতে পারে, আর অন্যরা শুধু তা অর্জনের চেষ্টা করলেই শাস্তি পায়। এর মাধ্যমে পাঠানো হয় এক বিষাক্ত বার্তা: নীতি নয়, ক্ষমতাই ঠিক করে কে কোন নিয়মে চলবে।
এখনই সময় এই ভয়াবহ ভণ্ডামির অবসান ঘটানোর। ইসরায়েলকে তার পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পর্কে স্বচ্ছ হতে উৎসাহিত করা উচিত, প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ আপাতত বাস্তবসম্মত না হলেও স্বচ্ছতা অর্জন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব। তাদের অস্ত্রভাণ্ডারের অস্তিত্ব স্বীকার করাটাই হবে প্রথম ধাপ যা ইসরায়েলকে আঞ্চলিক অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের আওতায় আনার পথ খুলে দেবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। ইসরায়েলের পারমাণবিক গোপনীয়তাকে সামরিক সহায়তা ও কূটনৈতিক সুরক্ষার মাধ্যমে সমর্থন দেওয়া শুধু ভণ্ডামিই নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ-এর জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর।
তদুপরি, আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও এখনই উদ্যোগ নিতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গঠনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত আলোচনা শুরু করতে। এমন একটি প্ল্যাটফর্ম শুধু ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলার জন্যও কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়ক হবে, একইসঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে আস্থা তৈরির সুযোগ করে দেবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো- বিশ্বকে পুনরায় নিরস্ত্রীকরণের নীতিকে নৈতিকতা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পারমাণবিক অস্ত্র এতটাই ধ্বংসাত্মক যে, সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ কখনোই ভূরাজনৈতিক পক্ষপাতের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বৈশ্বিক নীরবতা কোনো অসাবধানতা নয়- এটি সচেতনভাবে লালিত একটি নীতি, যা কৌশলগত সুবিধা ও রাজনৈতিক কাপুরুষতার ফল। কিন্তু এই নীরবতার মূল্য চরম: বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নৈতিক সামঞ্জস্য।
যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সত্যিকার অর্থে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে থাকে, তবে তাদের উচিত একই নিয়ম সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা। অন্যথায়, বার্তাটি স্পষ্ট: পারমাণবিক ভণ্ডামি শুধু সহ্য করা হয় না বরং সেটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এবং সেই প্রশ্ন, যা প্রতিটি কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারকের বিবেককে তাড়িত করা উচিত, তা হলো- এই ভণ্ডামিতে বিশ্ব আর কতদিন অভিনয় করে যেতে পারবে?
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক