পরিবেশের মারাত্মক অবনতি আমাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের পরিবেশগত বিপর্যয়। শব্দদূষণ বর্তমান সময়ে এক মারাত্মক সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। হাইড্রোলিক হর্ণ, উচ্চমাত্রায় মাইকের আওয়াজ ও কলকারখানার শব্দ। এরপর পানি দূষণ। দেশের ভূ-উপরিস্থ পানি শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, পৌর এলাকার অপরিশোধিত বর্জ্য পানি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, তেলবাহিত দূষণ এবং নদীবন্দর ও উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রবন্দর ও জাহাজ ভাঙা কর্মকাণ্ড থেকে নিঃসৃত তেলজাতীয় পদার্থ দ্বারা ক্রমাগত দূষিত হয়ে চলছে। আরো রয়েছে নিষিদ্ধ পলিথিনের অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার। পলিথিনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে প্লাস্টিক সামগ্রিকের ব্যবহার। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রায় জায়গায় ড্রেন কিংবা খাল ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন ও আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলা হয়। পলিথিন বা প্লাস্টিকের বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলে দিলে তা নর্দমায় আটকে গিয়ে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এর পানি আটকে গিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
বাংলাদেশের জলাবদ্ধতা শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নয়, বাংলাদেশের প্রায়ই শহর থেকে গ্রাম অবধি জলাবদ্ধতা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি সাধারণত জলাধার, খাল-বিল হয়ে নদীতে মিশে। শহর থেকে এই পানি দ্রুত বের হওয়ার পথ কোথায়? মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, শহরের মধ্যে নদী, খাল দখল করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাটি ভরাটের ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়, যা জলাবদ্ধতার সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর চাপ, আর অতি মুনাফা লোভী ভূমি দুর্বৃত্তদের প্রভাবে হারিয়ে গেছে এর অনেকটাই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত ব্যবস্থা। প্রকৃতির দোষটা কোথায়? আল্লাহর নেয়ামতকে ধ্বংস করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। করলে তার পরিনতি ভুগতে হবে। প্রতি বর্ষায় নগরবাসীর নাকাল অবস্থা। জলজটে শহরের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রায় জায়গায় ড্রেন কিংবা খাল ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির দরজা থেকে শুরু করে নদী, নালা, ড্রেন সবখানেই মিশে গিয়ে যেন পৃথিবীর শ্বাসরোধ করে ফেলেছে পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রী। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবর্জনা সরিয়ে না ফেলার কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ থাকায় জলাবদ্ধতায় আটকে যাচ্ছে যানবাহন, ডুবে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘর-বাড়ি, সেই সাথে পানিবন্দি হয়ে পড়ে মানুষ। ফলে দুর্ভোগ যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। আইন তো আছেই; কিন্তু মানা হচ্ছে কি? অন্যদিকে নগর জীবনে ভোগান্তির আরও একটি কারণ বায়ুদূষণ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বাড়ছে নাগরিক ভোগান্তি। বিভিন্ন নির্মাণকাজ এবং অন্যান্য উৎস থেকে অবারিত ধুলা নির্গমনের ফলে পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে। ধুলাবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে ফুসফুস কেন্দ্রিক রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইটভাটা। মানছে না আবাসিক এলাকা, মানছে না কৃষিজমি। পাহাড় কেটে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করে গড়ে তোলা হয় আবাসিক প্লট কিংবা দালানগৃহ। আবার কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ফসলি জমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ইটভাটাগুলোতে বেআইনিভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে বায়ু। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে শিল্পকারখানা, যানবাহনের অসম্পূর্ণ দহন থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের প্যাটিকুলেট ম্যাটার, অ্যাশ, ধূলিকণা, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই মিশে যাচ্ছে বায়ুতে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে চলছে। জনজীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও পানি দূষণ সমস্যা সমাধান অতীব জরুরি।
বিশ্ব পরিবেশবাদী আন্দোলনে স্টকহোম কনফারেন্স একটি মাইলফলক হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন পরিবেশকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতির বৃহৎ পরিসরে দেখার সুযোগ করে দেয়। স্টকহোমের কনফারেন্সে ১১৩টি দেশ, ১৯টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রায় ৪০০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে জাতিসংঘের পরিবেশ এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত সম্মেলন ১৯৯২ সালের ১৩ জুন ব্রাজিলের রিওডি জেনেরিওতে মিলিত হয়। যা ধরিত্রী সম্মেলন হিসাবে বহুল পরিচিত। এ সম্মেলনে ১৭৮টি দেশের প্রায় ১০ হাজার প্রতিনিধি এবং বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা যোগদান করে। পরিবেশ এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত এই রিও ঘোষণায় ২৭টি নীতিমালা করা হয়। উক্ত ঘোষণায় রয়েছে, উন্নয়নের অগ্রধিকারকে এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যাতে করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় প্রজন্মের উন্নয়ন ও পরিবেশগত প্রয়োজন ন্যায় সঙ্গতভাবে মেটানো সম্ভব হয়। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিবেশগত আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়। ১৫ এপ্রিল ১৯৯৪ তারিখে অনুসমর্থন করে এবং ২১ আগস্ট ২০০১ তারিখে কিয়োটো প্রটোকলে অনুপ্রবেশ (Access) করেছে। প্রত্যেক দেশের মতো আমাদের দেশেও পরিবেশ রক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন রয়েছে।
পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ ইত্যাদি আইন ও নীতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ধারা ৬ এর উপধারা (১) এ বলা হয়েছে স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবে না বা ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনোভাবে উক্ত যানবাহন চালু করা যাবে না।
ওই বিধান লঙ্ঘনকারীকে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড; দ্বিতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধন) ২০১০ এর ৭(১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তির কারণে পরিবেশ বা প্রতিবেশের ক্ষতি হলে সেই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক তা পরিশোধ করতে হবে এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা উভয় প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশের বিপর্যয়ের সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, সব আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও আমাদের তা নেই। কিন্তু সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ।
ইউনেসকোর তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ। প্রায়ই দেখা যায় শহরের কোনো উদ্যানে স্থাপনা নির্মাণে গাছ কাটা হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যেতে হবে, যা ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত না করে এবং পরিবেশ দূষণ না করে। অপরিকল্পিত নগরায়নের অভিঘাত নগর জীবনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। নগরীর মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য বৃক্ষরোপণ, সংরক্ষণ এবং প্রাণিকূলের আবাসস্থল বাঁচিয়ে রাখা দরকার। শহরের কংক্রিটের মাঝে কিছু সবুজায়ন জীবনে প্রশান্তি দেয়। দূষণ কমে। শহরে দৃষ্টি সীমানায় সবুজের অভাব রয়েছে। খুবই সীমিত বৃক্ষের উপস্থিতি যেগুলো যান্ত্রিক শহরের বায়ুকে নির্মলতা ও স্নিগ্ধতার পরশ দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। নগর প্রাণ ও প্রকৃতিকে সাজাতে সবুজের বিকল্প নেই।
সামাজিক বনবিধিমালা (২০০০), বন আইন (১৯২৭), পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ (১৯৭৭), পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধন) ২০১০ এবং বৃক্ষ সংরক্ষণ আইন ২০১২ আইন মেনে চলতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে মহামান্য উচ্চ আদালতের ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা সবার দায়িত্ব। এজন্য সবাইকে কাজ করা দরকার। রাজনৈতিক দক্ষতা, সকলের ম্যান্ডেট আর সমন্বিত প্রশাসনিক পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর স্বদেশভূমি নিশ্চিত করতে হবে। সুস্থ জীবনের জন্য, সবার কল্যাণার্থে গাছ উজাড় নয়, গাছ সংরক্ষণ করতে হবে। বৃক্ষের প্রয়োজনে নয়, আমাদের প্রয়োজনেই গাছ লাগাতে হবে। গাছের পরিচর্যা করতে হবে এবং অকারণে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। পাহাড় কাটা ও জলাভূমি ভরাট করা বন্ধ করতে হবে। নগরীকে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ রাখতে হলে সবার আগে নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে এবং পরিবেশবিষয়ক আলোচনা সভা কিংবা কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা থেকে প্রতিকার পেতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিকল্পনামাফিক পানি নিষ্কাশনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়। জনস্বার্থে সরকারকে জলাবদ্ধতা দূর করার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে জনগণ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পায়।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট