ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বৈষম্যহীন ও টেকসই বাজেট, কল্পনা নাকি বাস্তবতা?

ড. এ কে এম মাহমুদুল হক
বৈষম্যহীন ও টেকসই বাজেট, কল্পনা নাকি বাস্তবতা?

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বিপর্যস্ত আর্থিক খাত সংস্কার ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

২ জুন ২০২৫ রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবিত এ বাজেট ঘোষণা করেন। তার বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম ছিল- ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়।’

প্রস্তাবিত এই বাজেটটি যদি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা যায়, দেখা যাচ্ছে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় টাকার অংকে বাজেটের আকার কমছে ৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের চূড়ান্ত আকার (ব্যয়) ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

এতে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ)। এ থেকেই বোঝা যায় যে সরকার ঘাটতি কমানোর মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, যা একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এছাড়াও বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির গড় হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে কর থেকে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি এবং এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা আসবে। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

বাজেটের ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়- ঋণনির্ভরতা কি ভবিষ্যতের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না? বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এই বাজেট কতটা বৈপ্লবিক তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।

একদিকে বাজেটের আকার ০.৮৭ শতাংশ কমানো হয়েছে- যা বড় কোনো কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না।

অন্যদিকে বাজেট বক্তৃতায় ‘বৈষম্যহীনতা’ ও ‘টেকসইতা’ শব্দের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে তার প্রতিফলন তেমন দেখা যাচ্ছে না। ‘বৈষম্যহীনতা’ শব্দটি হয়তো এসেছে জুলাই বিপ্লবের আদর্শ থেকে এবং ‘টেকসই’ শব্দটি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের আদর্শে অনুপ্রাণিত। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এই শব্দগুলো কতটা কার্যকর, তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে।

‘টেকসইতা’ বলতে মূলত বোঝায় এমন উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যা পরিবেশ, সমাজ এবং অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে। অথচ টেকসই উন্নয়ন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমানো হয়েছে, যা গ্রামীণ উন্নয়ন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বুদ্ধিজীবী মহলের সুরও একই। অর্থনীতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ বা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, এবারের বাজেটে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ বা প্রত্যাশার কথা বলা হলেও যে কাঠামোয় বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেটি পুরনো। ফলে গতানুগতিক বাজেটের পুঞ্জিভূত সমস্যাগুলো এখানেও রয়ে গেছে। তার মতামত স্পষ্ট করে দেয় যে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে একটি ভিন্নধর্মী, সংস্কারমূলক বাজেট উপস্থাপন করার সুযোগ ছিল, যা তারা কাজে লাগাতে পারেননি।

কর কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এবারের বাজেটে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কর রেয়াতের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নারী করদাতা, স্বল্প বেতনপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, জুলাই আন্দোলনে হতাহত বা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কিছুটা শিথিলতা আনা হলেও, যারা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, তাদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেমন এখন ১০.৭৫ লাখ টাকার ওপরে পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে, যা পূর্বে ছিল ১৩.৫ লাখ টাকার ওপর। এটি স্পষ্টতই একটি অসম কাঠামো। ফলে যারা এরইমধ্যে কর দেন, তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

বিশেষভাবে বলার বিষয়, করের আওতা বাড়ানোর পরিবর্তে করহার বাড়ানো হয়েছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত করের আওতা বাড়াতে প্রযুক্তিনির্ভর কর সংগ্রহ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যেখানে করদাতারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বজায় রেখে সহজেই কর প্রদান করতে পারেন। বাংলাদেশেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম উন্নয়ন করে কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা প্রয়োজন।

আরেকটি ন্যায়ের প্রশ্ন আসে কালো টাকা সাদা করার বিধান নিয়ে। প্রতি বছর বাজেটে এই ধারা বহাল রাখা হয়, যা একদিকে দুর্নীতিবাজদের পুরস্কৃত করে, অন্যদিকে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করে। এমন একটি ব্যবস্থা ‘বৈষম্যহীন’ বাজেটের ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

পরিবেশ সংক্রান্ত বাজেট বরাদ্দেও রয়েছে উদ্বেগজনক সংকোচন। বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, পানি সম্পদ, পল্লী উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ কোথাও কমানো হয়েছে, কোথাও তা খুবই নগণ্য। এমন সময়ে যখন বিশ্ব জলবায়ু সংকটে ভুগছে, তখন এই খাতগুলোতে বরাদ্দ হ্রাস করা টেকসই উন্নয়নের ধারণার পরিপন্থি। ভারতের কেরালা রাজ্য প্রতিবছর বাজেটের একটি নির্দিষ্ট অংশ গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও পুনঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দিয়ে থাকে, যা বাংলাদেশেও অনুসরণযোগ্য হতে পারে।

এই বাজেটের আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ দিক হলো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট (এপ্রিল) অনুযায়ী, দেশে বিনিয়োগের হার কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং যুবসমাজের মধ্যে কর্মসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে ‘উৎপাদনশীল বিনিয়োগ’, ‘সবুজ শিল্পায়ন’ কিংবা ‘স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম’ গড়ে তোলার কার্যকর রূপরেখা অনুপস্থিত।

ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়া এদিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, যেখানে বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ হয় প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান, স্টার্টআপ তহবিল এবং স্মার্ট উৎপাদন খাতে। ইউনাইপেড নেশনস এনভারনমেন্ট প্রোগ্রাম-ইউএনইপি-এর মতে, জলবায়ু সহনশীল উন্নয়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাজেটের কমপক্ষে ২ শতাংশ পরিবেশ ও অভিযোজন খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেট সেই মানদ- পূরণে ব্যর্থ।

বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি থাকলেও, কার্যকর পদক্ষেপের অভাব লক্ষণীয়। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আবার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও, তার ভিত্তি কোথায় তা স্পষ্ট নয়।

এই বাজেটে সবচেয়ে বড় যে দুর্বলতা তা হলো- কোনো প্রকৃত কাঠামোগত সংস্কারের পদক্ষেপ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মানগত উন্নয়ন, যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিস্তারে যতটা প্রয়োজন, ততটা মনোযোগ দেখা যায় না। অথচ দক্ষিণ কোরিয়া তাদের বাজেটের একটি বড় অংশ দক্ষতা উন্নয়ন ও মানবসম্পদ গঠনে ব্যয় করে থাকে, যার ফলে তারা একটি শক্তিশালী ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে পেরেছে।

পরিশেষে বলা যায়, বাজেটটি উচ্চাশার প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তব কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কোনো প্রতিফলন নেই। ঘোষিত ‘বৈষম্যহীনতা’ ও ‘টেকসইতা’র লক্ষ্যে এটি অনেকাংশেই ব্যর্থ। বরং এটি এখনো সেই পুরোনো রাজনৈতিক দল ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে তৈরি একটি বাজেট।

প্রধান উপদেষ্টার প্রজ্ঞা ও দর্শনের গভীর প্রতিফলন যে দেশের মানুষ আশা করেছিল, তা এখানে অনুপস্থিত। হয়তো এই সরকার একটি দায়সারা নির্বাচনের বাইরে জনগণকে আর কিছু দিতে চায় না। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়- এই বাজেট কি সত্যিই জনগণের প্রত্যাশা পূরণের বাজেট, নাকি কেবলমাত্র শব্দচাতুর্যের ফাঁদে আটকে থাকা এক দায়সারা আনুষ্ঠানিকতা?

ড. এ কে এম মাহমুদুল হক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত