ক’দিন আগেও যেখানে মানুষের ঘুম ভাঙতো পাখির ডাকে, সেখানে এখন ঘুম ভাঙে শব্দণ্ডসন্ত্রাসে, বাস, মোটর গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশার তীব্র, হর্ণে। পিলে চমকানো ধাতব শব্দে চমকে ওঠে আজকাল শহরের বেশিরভাগ এলাকার মানুষ। শুরু হয় শব্দ কলুষিত প্রতিবেশের এক একটি দিন। সারাদিন শব্দ দানবের নিপীড়ন শরীরের সমস্ত স্নায়ু আচ্ছন্ন করে রাখে। এরপর আছে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় মাইকের জ্বালাতন, ফেরিওয়ালার চিৎকার, রেস্তোরাঁর টেপ রেকর্ডারের প্রবল প্রতাপের হিন্দি গান, বাসের হেলপার-কন্ট্রাক্টরের ছোটখাট বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়াঝাটি, ট্র্যাফিক জ্যাম কিংবা সাধারণ মানুষের ভিড়ের অনিবার্য শব্দাবলি।
শব্দ প্রতিবেশের শত্রু। সাধারণ শত্রু নয়- মারাত্মক শত্রু। তাই বলে প্রাকৃতিক শব্দ মানবদেহের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। যতো সর্বনাশের মূল আমাদের নিজেদের তৈরি শব্দ।
মানুষের কাছে শব্দের সহনীয় একটা সীমা আছে। সে সীমা ছাড়িয়ে গেলেই শব্দ হয়ে ওঠে কর্কশ। শব্দের তীব্রতা প্রকাশ করা হয় একক ডেসিবেলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের কাছে শব্দের সহনীয় মাত্রা ৬০ ডেসিবেল। এর ওপরে গেলেই সে শব্দ বাঞ্চিত থাকে না, হয়ে পড়ে অবাঞ্চিত। এই অবাঞ্চিত তথা কর্কশ শব্দ নিয়েই আমাদের যতো ভোগান্তি। শব্দের মাত্রা ৮০ ডেসিবেল হলে সাময়িকভাবে বধির এবং ১০০ ডেসিবেল হলে একেবারে কালা হবার আশঙ্কা থাকে। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, নিজেদের উৎপাদিত শব্দের মাধ্যমে নিজেদের কী নিদারুণ ক্ষতি করছি, চারপাশের মানুষের ক্ষতির কারণ হচ্ছি।
মোটরের হর্ণে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তার মাত্রা ৯৫ ডেসিবেল। মাইকে হয় ৯২ থেকে ১০০ ডেসিবেল, ট্রাকে ও বাসে হয় ৯২ থেকে ৯৪ ডেসিবেল, কল-কারখানায় হয় ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবেল, ব্যান্ড-মিউজিকে ১৩০ ডেসিবেল আর বোমায় বাঞ্চিত মাত্রার প্রায় আড়াই গুণ ১৪০ ডেসিবেল। তাহলে দাঁড়াল কী! একজন মানুষ যেখানে মাত্র ৬০ ডেসিবেল শব্দ শোনার ক্ষমতা রাখে, সেখানে তাকে প্রায়ই অতিরিক্ত মাত্রার শব্দ তথা সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে কাটাতে হচ্ছে প্রতিটি দিন। একজন সুস্থ মানুষের কাছে যেখানে অতিরিক্ত মাত্রার শব্দ অত্যাচারে বলে মনে হয়, সেখানে অসুস্থ মানুষের কাছে এটা কতখানি কষ্টকর আর অসহনীয়, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের শিশুরা তো এই শব্দভারে অকালেই পঙ্গু হয়ে বড় হচ্ছে।
আর তাই তীব্র শব্দ শিশু, বৃদ্ধ, রোগী আর গর্ভবতী মায়েদের জন্য অভিশাপের মত। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, তীব্র কর্কশ শব্দের ফলে মাতৃগর্ভস্থ শিশু জন্মাবার পর বিকলাঙ্গ, জড়বুদ্ধি সম্পন্ন, কিংবা মুক ও বধিরও হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, রক্তচাপ আর হৃৎপিণ্ডের যত ব্যাধি, তার সবচেয়ে বড় কারণ অতিরিক্ত উচ্চ শব্দ। শব্দ অনেক উপায়ে মানুষের ক্ষতি করে। প্রচণ্ড শব্দ কানের ভেতরের পাতলা পর্দা আর মেমব্রেনের স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোলাল্ড রিগান প্রথম জীবনে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় তার কানের কাছে পিস্তলের ফাঁকা ফায়ার করা হয়। ওই শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়।
কানটি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর কখনও তিনি ঐ কানে শুনতে পাননি। শুধু কি কানের ক্ষতি? উচ্চ শব্দ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। যাদের হার্ট এনলার্জ হয়ে গেছে, তারা যদি উচ্চ শব্দের মধ্যে বাস করে, তবে হার্ট স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
ক্রমাগত উচ্চ শব্দ মানুষের শরীরের স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কখনও কখনও তা মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া ঘুমের ভেতর শব্দের আক্রমণ মানুষের নার্ভাস সিস্টেমে যে প্রতিক্রিয়া ঘটায়, তার সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা যায় মারাত্মক বিষক্রিয়ার। শৈশবে প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে বেড়ে উঠলে মানুষ যৌবনে রতিশক্তিহীন হতে পারে। বার্ধক্যে হাইপারটেনশন, কনভালশন ডিজ অর্ডার, ডায়াবেটিস, এসব রোগেও ভোগে অনেকে শুধুমাত্র উচ্চ শব্দের কারণে।
মানসিক রোগীদের জন্য শব্দ সৃষ্টি করে এক ধরনের সমস্যা। তাদের শ্রবণেন্দ্রিয় সাধারণত সুস্থ মানুষের চেয়ে বেশি স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। যখন তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম আর ঘুম দরকার, তখন শব্দ তাদের নার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে। তখন তারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে এখনই। অন্য দশটা সামাজিক সমস্যার মতো এটিও চোখ বুঁজে মেনে নিলে চলবে না। নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকের এ ব্যাপারে রয়েছে কর্তব্য। সেটা হলো নিরন্তর প্রতিবাদ করে যাওয়া। অন্য দশটা সমস্যা বা অশুভ অবস্থার বিরুদ্ধে যেমন সব সময় প্রতিবাদে সোচ্চার হই তেমনি আমাদের উচিত তীব্র শব্দের বিরুদ্ধেও নিজেদের ভূমিকা রাখা।
এজন্য শুরু করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে। এরপর আসবে পারিবারিক পর্যায়। আমাদের সবাইকে চারপাশের সমাজের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
বুঝতে হবে, ভয়ংকর সব শব্দ উৎপাদন কোন গর্বের বিষয় নয়, এতে সত্যিকার কোনো বিনোদনও নেই আমাদের ক্রিয়া-কর্ম, ধর্ম পালন, সংস্কৃতি চর্চা সব কিছুর মধ্যে পরিশীলিত রুচির বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, চারপাশের সব মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আমাদের সুখ-দুঃখ জড়িয়ে আছে। আমার উৎপাদিত শব্দ যদি অন্যের দুর্ভোগ আর নিপীড়নের কারণ হয়, তবে তা আর শব্দ থাকবে না, রূপ নেবে শব্দ সন্ত্রাসে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক।