সাংবাদিক কে? সাংবাদিকের দায়িত্ব সীমা কতটুকু? এসব বিষয় নিয়ে সারাবিশ্বেই প্রতিনিয়ত আলোচনা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একটি গেস্ট হাউসে সাংবাদিক পরিচয়ে এক দুর্বৃত্তের ক্যামেরা নিয়ে তল্লাশি চালানো ও ঢাকার বিভিন্ন সড়কে তল্লাশি চালানোর সময় মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভিডিও ধারণ ও সম্প্রচারে নতুন করে এই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। নতুন করে সামনে এসেছে সাংবাদিকের দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি। অবাধ ইন্টারনেট সংযোগের যুগে কে সাংবাদিক আর কে অনলাইন প্রচারকারী তা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এই সুযোগে আসুন একটু নতুন করে জেনে নিই কে সাংবাদিক আর কে নন।
তথ্যপ্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। তথ্য বিনিময় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রকৃতির নিয়মেই মানুষ তথ্য জানতে চায়, অন্যকে জানাতে চায়। বরং অবাধ তথ্য বিনিময়ে বাধা তৈরি মানবাধিকার লঙ্ঘন। একজন অতি সাধারণ মানুষ যেমন প্রাপ্ত তথ্য বিনিময় করে থাকেন, একজন সাংবাদিকও গণমাধ্যমের আশ্রয়ে গণমানুষের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে থাকেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন আগে তথ্য বলতে বলতে শুধু বর্ণমালা লিখিত উপাত্তকে বোঝালেও ইউনেস্কোর সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে তথ্য বলতে- ছবি, ভিডিও, অডিও, গ্রাফিক্স, কার্টুনসহ নানাবিধ বিষয়কে বোঝায়। যার মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব বিনিময় করে থাকেন। তথ্য প্রাপ্তি ও বিনিময় নিয়ে একজন আটপৌরে সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকতার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। তবে রয়েছে সুস্পষ্ট বৈসাদৃশ্য ও দায়বদ্ধতার মাপকাঠি। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে একজন সাধারণ নাগরিক ও সাংবাদিকের মধ্যে তফাত অনেকটা কমিয়ে এনেছে। যদিও একজন নাগরিক ও সাংবাদিকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য এখনও বিদ্যমান। সেই পার্থক্য না করতে পারার কারণেই অনেকেই বিপদে পড়ছেন। যাকে ইউনেস্কোর ভাষায় বলা হয় ফাঁদ (Hoaxes).
তাত্ত্বিক আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। জাওয়াদুর রহমান বাংলাদেশের একজন গুণী সাংবাদিক। দৈনিক বাংলাসহ বাংলাদেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাংবাদিক নামের সম্পাদিত গ্রন্থে তিনি সাংবাদিকতার নীতিমালা শিরোনামের একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধে সাংবাদিকের দায়িত্ব কর্তব্য একজন শল্যবিদের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, একজন চিকিৎসকের হাতের অতি ধারালো ছুরি-কাঁচি ও একজন সমাজবিরোধী সন্ত্রাসীর হাতের ছুড়ি-কাঁচির মধ্যে পার্থক্য আছে। শল্য চিকিৎসক মানুষের শরীরে ছুরি-কাঁচি চালান আরোগ্য লাভের আশায় আর সন্ত্রাসী মানুষের শরীরে ধারালো অস্ত্র ঠেকান প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে।
জাওয়াদুর রহমান তথ্যকে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার প্রেক্ষাপটে বলেছেন, একজন সাংবাদিককে কিছু কাজ করতে হবে আর কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
যেটা আধুনিক যুগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য বিনিময়কারীদের সঙ্গে প্রযোজ্য নয়। জাওয়াদুর রহমানের ভাষায়, দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা সাংবাদিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। (সাংবাদিকতা, ১৯৯১, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-১৪৫) সাংবাদিক বা Journalist শব্দটির উৎপত্তি ১৭০১ সালে। Journalist বা সাংবাদিক শব্দটি উৎপত্তি হয় ফরাসি শব্দ journaliste থেকে। এই ফরাসি journaliste শব্দটি আবার উৎপত্তি হয় ল্যাটিন শব্দ diurnalis থেকে। যার অর্থ প্রত্যাহিক (daily)। প্রথমে এই ডিয়ারনালিস (diurnalis) শব্দটি থেকে journal শব্দের উদ্ভব হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় প্রতিদিনের জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত বা রেকর্ড। আর এখান থেকেই উৎপত্তি Journalist শব্দের যার অর্থ যিনি জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত বা রেকর্ড করে থাকেন।
বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা Routledge Taylor Francis Group থেকে ২০০৫ প্রকাশিত Making Journalists গ্রন্থে David H. Weaver নামের এক তাত্ত্বিক সাংবাদিকের একাডেমিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গ্রন্থটিতে Who are Journalist? নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, সাংবাদিক কে বা কারা সেটা দীর্ঘদিন যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে সাংবাদিকতা একটি কাঠামোগত ভিত্তি পায়। যাতে সাংবাদিক বলতে বোঝানো হয়, the term journalist came to describe reporters, writers, correspondents, columnists, newsmen (and a fwe newswomen), and editors who worked mainly for newspapers and magayines. In the twentieth century, the word was broadened to include radio and television news announcers, reporters, editors, and some online writers and editors. (Page: 44)
এর আগে সাংবাদিককে নানাভাবে ডাকা হতো। কেউ বলতেন কাগজের ভদ্রলোক (Gentlemen of Pad), কেউ বলতেন হিজিবিজি লেখার লোক (Man of scribble), কেউ সাংবাদিককে ডাকতেন সরকারি লেখক বলে (Public writer), কারও চোখে সাংবাদিক ছিলেন সংবাদ সংগ্রহকারী (News Monger), কেউ আবার বলতেন রাজলেখক (Court pamphleteer), কারও কাছে ছিলেন চলতি ঘটনাবলীর সৃষ্টিকারী (Curanto Maker)।
এছাড়াও কারও কাছে সাংবাদিক ছিলেন সব্যসাচী, কারও কাছে নেতিবাচক অর্থে চর (Intelligencer)। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে সাংবাদিকের এই ভূমিকা অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। সাংবাদিক এখন শুধু একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তথ্য প্রদানকারীই নন, একজন সাংবাদিক বহু মানুষের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক (Influencer)।
যেহেতু এখন খুব সহজে একজন সাংবাদিকের সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকা যায়, যেহেতু একজন সংবাদকর্মী প্রতিনিয়ত তার সংবাদ, মতামত ও মূল্যায়ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনিময় করেন সেহেতু মানুষ তাদের ওপর বেশি ভরসা করে থাকেন, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। এই একই তথ্য প্রদান ও প্রভাবকের কাজ একজন অসাংবাদিক প্রভাবকও করতে পারেন। যদিও সাংবাদিক (Reporter) ও শুধু একজন প্রভাবকের (Influencer) মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
এখানে একজন পেশাজীবী সাংবাদিকের প্রভাবক ভূমিকা ও একজন আমজনতার প্রভাবক ভূমিকার পার্থক্য রয়েছে। যার জন্য আমাদের যেতে হবে ইউনেস্কোর কাছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক এই সংস্থা সাংবাদিকতার বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কারণ এই সংস্থা মনে করে সমাজে মানুষের মতো প্রকাশ, জবাবদিহিতা তৈরি, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ ও সার্বিকভাবে জনকল্যাণ নিশ্চিতে সাংবাদিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এছাড়া দুর্যোগ, দুর্বিপাক, যুদ্ধ, মহামারিতেও সাংবাদিক সমাজের জন্য পরিবর্তন সৃষ্টিকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।
ইউনেস্কোর সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন সাংবাদিক হলেন, Professionals hired by media organi“ations to research, investigate, interpret, edit, write and produce news and media content through television, radio and other media. This term includes announcers/anchors employed by broadcasting organi“ations but excludes occupations such as public relations officer, photojournalist and camera operator.
অর্থাৎ সাংবাদিক হলেন এমন একজন ব্যক্তি যাকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া হয়। যার প্রধান কাজ হলো সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্য গবেষণা, অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা করা, সম্পাদনা করা, লেখা ও সংবাদ তৈরি করা। এর মধ্যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়োগকৃত সংবাদ উপস্থাপক, ফটো সাংবাদিক, ভিডিও সাংবাদিক সবাই পড়েন। তবে জনসংযোগ কর্মকর্তা পড়বেন না। যদিও একজন জনসংযোগ কর্মকর্তাও অনেক তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করে থাকেন।
২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মারা যান ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। নিশ্চিতভাবেই এই খবরটি ওই দিনের বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রধান সংবাদ ছিল। কিন্তু রানির মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। বর্তমানে স্কাই নেটওয়ার্কে কর্মরত সাংবাদিক ইলায়দা হাকিম তখন তিনি বিবিসিতে প্রতিবেদক ও উপস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
রানির মৃত্যুর খবর দাপ্তরিকভাবে প্রকাশের আগেই তিনি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্ল্যাটফর্মে (সাবেক টুইটার বর্তমান এক্স) ঘোষণা দেন, BREAKING: Queen Elizabeth II has died aged 96. Buckingham Palace has announced.সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই বার্তা তখন আগুনের গতিতে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও তখন বাকিংহাম প্যালেস আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি।
বিষয়টি সাংবাদিক ইলায়দা হাকিম ও বিবিবিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় অতি দ্রুত তিনি সেই টুইট সংশোধন করে লেখেন, ও tweeted that there had been an announcement about the death of the Queen. This was incorrect, there has been no announcement, and so I have deleted the tweet. I apologise.
এই ঘটনাটি একটি বড় শিক্ষা। একজন সাংবাদিক তথ্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পাদনা নীতির বাইরে কোনো তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করতে পারেন না। এটা তার পেশাগত দায়বদ্ধতার বিপরীত। একজন সাংবাদিককে মানুষ গ্রহণযোগ্য ও সত্য তথ্যের সূত্র হিসেবে বিশ্বাস করে থাকেন। তাই তিনি কোনো অবস্থাতেই কোনো মানুষের মৃত্যুর খবর যথাযথ কর্তৃপক্ষের (চিকিৎসক ও পরিবার) ঘোষণা ছাড়া প্রচার করতে পারেন না।
এই মৃত্যুর ঘোষণা বা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অবলীলায় প্রচার বা প্রকাশ করতে পারেন। তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সেই সংবেদনশীল তথ্য মিথ্যা হলেও তার কারও কাছে জবাবদিহিতার সুযোগ নেই। কিন্তু সাংবাদিককে জবাবদিহিতা করতে হয়, পেশাগত দায়িত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। এটাই সাংবাদিকতা পেশার মূলমন্ত্র।
আরও একটি বিষয়ে সাংবাদিক ও সাধারণ অনলাইন ব্যবহারকারী পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী একজন সাংবাদিককে মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকতে হয়। এমনকি অভিযুক্ত অপরাধীর ক্ষেত্রেও তাকে সচেতন থাকতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হয় প্রকাশিত সংবাদ, ছবি বা ভিডিওর মাধ্যমে যাতে কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তিকে দানবীকরণ (Demonization) করা না হয়।
কারণ এর মাধ্যমে কোনো মানুষের জীবনে স্থায়ী ক্ষত তৈরি হতে পারে। যা একজন মানুষের জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সাংবাদিককে হতে হয় অত্যন্ত দায়িত্বশীল।
অনলাইন প্রচারকারী বা একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর এক্ষেত্রে এই বাস্তবতা প্রযোজ্য নয়। আর মনে রাখা প্রয়োজন একজন অতি সাধারণ অনলাইন ব্যবহারকারীর প্রচারিত বা প্রকাশিত তথ্য গ্রহণযোগ্যও নয়। তাই অনলাইন ব্যবহারীর তথ্য (ছবি, ভিডিও, অডিও, গ্রাফিক্স) বিশ্বাস ও বিনিময় করার আগে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো বর্তমান তথ্য মহামারির যুগে (Infodemic World) কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমও ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল, অসত্য তথ্য ছড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতা খুবই জরুরি।
সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়