ঢাকা বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফেল করাটাই শেষ নয় বরং নতুন করে শুরুর সুযোগ

মাহমুদুল হাসান শোভন
ফেল করাটাই শেষ নয় বরং নতুন করে শুরুর সুযোগ

পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া মানেই জীবনে ব্যর্থতা এই ধ্যানধারণা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। একজন ছাত্র যদি কোনো পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারে, তা তার জীবনের পুরো সাফল্য বা ব্যর্থতার মাপকাঠি হতে পারে না। কারণ জীবনে সফল হওয়ার জন্য শুধু একাডেমিক পরীক্ষার ফল নয়, দরকার আত্মবিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম, সৃজনশীলতা ও ধৈর্য। পরীক্ষা আসলে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান বা মেধার সবকিছু প্রকাশ করতে পারে না। অনেক সময় মানসিক চাপ, পারিবারিক সমস্যা কিংবা অসুস্থতার কারণেও কেউ খারাপ করতে পারে। তাই শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কাউকে ব্যর্থ বলে মনে করা ঠিক নয়। সমাজ, পরিবার ও শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো এবং ব্যর্থতার মধ্যেও সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে সাহায্য করা। তাছাড়া, ব্যর্থতা শেখার একটি বড় সুযোগ। একজন ব্যর্থ ছাত্র যদি নিজের ভুলগুলো বিশ্লেষণ করে, তাহলে সে ভবিষ্যতে আরও শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। জীবনে সফলতা মানে শুধু ভালো নম্বর পাওয়া নয়, বরং জীবনের প্রতিকূল অবস্থায় নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখা এবং এগিয়ে যাওয়াই প্রকৃত সফলতা। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াকে যদি জীবনের শেষ মনে করা হয়, তাহলে সমাজ অনেক প্রতিভাকে হারিয়ে ফেলবে। বরং উচিত এই ব্যর্থতাকে সাময়িক ধাক্কা হিসেবে দেখে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা নেওয়া। মনে রাখতে হবে, শেষ কথা বলেন না কোনো পরীক্ষার ফল, বরং জীবন যুদ্ধে যে থেমে যায় না, সেই-ই সত্যিকারের বিজয়ী। সুতরাং, পরীক্ষা ব্যর্থতা মানেই জীবন ব্যর্থ- এই ভুল চিন্তা পরিত্যাগ করুন এবং নতুনভাবে পথ খোঁজার সাহস গড়ে তুলুন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও সফল হওয়া মানুষের জীবনের গল্পগুলো আমাদের শেখায় যে, ব্যর্থতা কখনোই শেষ নয়, বরং একটি নতুন শুরু। জীবনের প্রকৃত মানে হলো বারবার পড়ে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ানো। কিছু মানুষ জীবনে পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে জীবনে অসামান্য সফলতা অর্জন করেছেন। আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন একজন সাধারণ মানসিক বিকাশের শিশু। ছোটবেলায় তিনি কথা বলতে শেখেন অনেক দেরিতে, শিক্ষকরা মনে করতেন তার মধ্যে কোনো মেধা নেই। তিনি একাধিকবার স্কুলে পড়াশোনায় খারাপ ফল করেন, এমনকি ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন টেস্টেও প্রথমে ব্যর্থ হন। কিন্তু এই ব্যর্থতা তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। কঠোর অধ্যবসায়, চিন্তাশীলতা ও বৈজ্ঞানিক কল্পনার মাধ্যমে তিনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। থমাস আলভা এডিসন ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি শৈশবে স্কুলে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষকরা তাকে ‘বোকা’ বলে ঘোষণা করে, তার মা নিজেই পরে তাকে পড়াতেন। বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের পথে তিনি প্রায় এক হাজারবার ব্যর্থ হন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। পরবর্তীতে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত হন এবং হাজারের বেশি আবিষ্কারের পেটেন্টের মালিক হন। স্টিভ জবস কলেজ থেকে ড্রপআউট করেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসম্পূর্ণ ছিল এবং অ্যাপল কোম্পানি থেকে এক সময় তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজের দক্ষতা, ভবিষ্যৎ চিন্তা ও সৃজনশীলতা দিয়ে অ্যাপলকে আবার গড়ে তোলেন। আজ অ্যাপল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ব্র্যানসন ছিলেন ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত। স্কুলে তিনি বারবার ফেল করতেন, পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে উদ্যোক্তা মানসিকতা ছিল প্রবল। আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী, যার অধীনে শত শত কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে। মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষ না করেই ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি সফল না হলেও তার চিন্তা ও প্রযুক্তি দক্ষতা তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালাম ছোটবেলায় দারিদ্র্যের কারণে অনেক কষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে যান। অনেকবার পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলেও তিনি হাল ছাড়েননি। কঠোর পরিশ্রম ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার মাধ্যমে তিনি ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন দারিদ্র্যপীড়িত, নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন, বিভিন্ন কাজ করেছেন জীবিকা নির্বাহের জন্য। কিন্তু তার লেখনী, বিদ্রোহী মনোভাব ও সাহসিকতা তাকে বাংলা সাহিত্যের অমর কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই মানুষদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা যায় একটি পরীক্ষার ফলাফল জীবনকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। ব্যর্থতা যত বড়ই হোক না কেন, তা যদি মানুষকে দৃঢ় করে তোলে, তবে সেটাই একদিন সফলতার পাথেয় হয়ে ওঠে। সফলতা আসে বিশ্বাস, পরিশ্রম ও ধৈর্যের মাধ্যমে শুধু পরীক্ষার নম্বর দিয়ে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত