ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সৈকতে গোসল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

এমরান চৌধুরী
সৈকতে গোসল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

অফিস ছুটিতে বা ব্যস্ততম কর্মজীবনের ফাঁকে অনেকে সপরিবারে কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে থাকেন। আর বেড়াতে গেলে সমুদ্রের পানিতে গোসল না করে কি ফিরে আসা চলে? নিশ্চয় চলে না। সেই কৌতূহলবশে নেমে পড়েন সমুদ্রের পানিতে। কিন্তু সমুদ্রের পানিতে নামার আগে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি যে ভাবা দরকার তা বোধহয় অনেকে বেমালুম ভুলে যান। আবেগ-আনন্দের আতিশয্যে এতই বিভোর থাকেন- আগ পিছ না ভেবে নেমে পড়েন পানিতে।

সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে নেমে তিন পর্যটক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। একইভাবে আরও দুইজন স্থানীয় লোকের মৃত্যু হয়েছে। গত ৮ জুন থেকে ১০ জুন মাত্র দুইদিনের ব্যবধানে এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে (দৈনিক আজাদী, তাং-১৩/০৬/২৫)। এভাবে সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে নেমে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিন্তু এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধ করা যায়, নিজেদের অতিরিক্ত কৌতূহল-ইচ্ছার যদি লাগাম টেনে ধরা যায়। দুর্ঘটনার সময়জ্ঞান নেই। কখন কোথায় কীভাবে মৃত্যু হানা দিতে পারে কেউ জানে না। কিন্তু চোখের পলকেই ঘটতে পারে দুঃখজনক ঘটনা। আপনি পায়ে হেঁটে, গাড়িতে চড়ে, শহরের ব্যস্ততম সড়কে বেরিয়ে নিরাপদে বাসা-বাড়িতে ফিরবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জলপথ কিংবা আকাশ পথ কোনো পথই এই নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আর তাই মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ হওয়া উচিত সন্তর্পণে। বিবেক খাটিয়ে অবস্থা অনুকূল থাকলে তখনই সমুদ্রে গোসলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাওয়া উচিত। সমুদ্রে কোথায় কখন গোসল করা যাবে, আর কখন যাবে না, এ বিষয়ে খুব পরিষ্কার নির্দেশনা থাকে। আপনি যদি নির্দেশনা মেনে সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে নামেন আল্লাহ পাক চাইলে আপনি ছহিছালামতে ফিরে আসবেন। মনে রাখতে হবে, আপনার শূন্যতা আপনার অবর্তমানে কেউ না কেউ সারাজীবন বয়ে বেড়াবে। সুতরাং এটা ভাবার অবকাশ নেই আপনি নাই হয়ে গেলে কার কি এসে যায়? কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ঈদ-পার্বনে তো বটেই প্রায় সারা বছর পর্যটকের ভিড় থাকে। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের কলাতলী থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভিড় থাকে বেশি। একটি স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘এই ৩ কিলোমিটারের মধ্যে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। যেখানে রয়েছে গুপ্তখাল ও চোরাবালি। এর মধ্যে সি-গাল পয়েন্ট, ডিভাইন পয়েন্ট ও লাবনীর দক্ষিণে একটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে এ সব চিহ্ন করে সেখানে পর্যটকদের পানিতে না নামতে নিষেধ রয়েছে। কিন্তু বহু পর্যটক নিষেধ না মেনে সেখানে নেমে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অধিকাংশ পর্যটক নির্দিষ্ট সীমারে বাইরে গিয়ে সাগরে অসতর্ক অবস্থায় গোসল করে। এসময় ঢেউয়ের আকস্মিক তোড়ে গভীর সাগরে ভেসে যায়। এ সময় লোকজন বেশি থাকায় লাইফগাইর্ড কর্মীরা দ্রুত খবর পায় না। খবর পেয়ে উদ্ধার করতে করতে মৃত্যুমুখে পতিত হয় অনেকে’ (দৈনিক আজাদী, তাং-১৩/০৬/২৫)। শুধুমাত্র ৩ কিলোমিটার এলাকায় ২৭ জন কর্মী নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থা উদ্ধার কাজে নিয়োজিত আছে। হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে মাত্র ২৭ জন উদ্ধার কর্মী নিতান্ত অপ্রতুল। অন্যদিকে সমুদ্রসৈকতের ১১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোনো উদ্ধারকর্মী নেই। টেকনাফ, বাহারছড়া, পাটুয়ার টেক, ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, শৈবাল ও মাদ্রাসা পয়েন্টের সৈকতে কেউ গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কেউ নেই।

আমরা জানি, পৃথিবীতে নানা দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এ সব জায়গায় বছরের বিভিন্ন সময়ে পর্যটকদের ঢল নামে। তেমনি একটি পর্যটন শহর কক্সবাজার। যার রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজার আবহাওয়া ও সৈকত দর্শনে বাংলাদেশের মানুষ তো বটেই, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপ্রেমীরা ভিড় জমায় কক্সবাজারে। পর্যটন খাতে রয়েছে, বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। তারজন্য যেমন প্রয়োজন পর্যটকদের প্রয়োজনীয় আবাসন সুবিধা, যোগাযোগব্যবস্থা ও নিরাপত্তার, তেমনি প্রয়োজন সৈকতে গোসল করতে নামা মানুষের সর্বোত্তম নিরাপত্তা।

যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তাহলো-

১. সৈকতে গোসলের সময় পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য লাইফগার্ডদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা উচিত। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে যেসব লাইফগার্ড কর্মরত তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যে কোনো পর্যটক গোসল করতে নামার আগে একজন লাইফগার্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নামা সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ বিপদের হাত-পা নেই। এক্ষেত্রে লাইফগার্ডরা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করতে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে পারবে।

২. সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন স্থানে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করা উচিত, যেখান থেকে লাইফগার্ডরা পুরো এলাকা নজরে রাখতে পারেন।

৩. সৈকতে উপস্থিতি অনুয়ায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা উচিত। যার ফলে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত সহজ হবে এবং পর্যটকরা নিশ্চিন্তভাবে বিনোদনের সঙ্গে সৈকতে গোসল করতে পারবে।

৪. সমুদ্রের অবস্থা বিপজ্জনক হলে পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন রঙের যে পতাকা ব্যবহার করা হয় সে সতর্কতা মেনে চলতে পর্যটকদের সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

৫. সৈকতে অ্যাম্বুলেন্স এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল প্রস্তুত রাখতে হবে।

৬. পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশিকা দেওয়া উচিত, যা তাদের সমুদ্রসৈকতে নিরাপদ থাকতে সাহায্য করবে।

৭. সৈকতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা উচিত, যা পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করবে।

৮. নিয়মিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল থাকতে হবে, যাতে পর্যটকরা নিরাপদ বোধ করে।

উপর্যুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করা গেলে পর্যটকরা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে একটি নিরাপদ এবং আনন্দদায়ক সময় কাটাতে পারবে। এতে করে পর্যটন খাতে আমাদের আয় যেমন বাড়বে, তেমনি বিদেশি পর্যটকরা আগ্রহী হবে কক্সবাজারের অপূর্ব, অনন্য সৌন্দর্য উপভোগে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত