একটি দেশের জনসংখ্যা তখনই সম্পদে পরিণত হয়, যখন তাকে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যেসব দেশ এটা করতে পারে, তারা জনমিতির লভ্যাংশ পায় আর যারা পারে না, সেসব দেশে জনসংখ্যা বোঝায় পরিণত হয়। এ প্রেক্ষাপটে দেখলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে কোনোভাবে সম্পদ হিসেবে গণ্য করা যায় না। আমাদের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখনও আর্থিক সক্ষমতার অভাবে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যেই শিক্ষা দরকার, তা-ও তারা পাচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে ১৪ জুলাই ‘বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০২৫’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগের জনসংখ্যা নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালে। সেই নীতিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হলেও খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। গত কয়েক বছর প্রজনন হার একই স্থানে থমকে আছে। কমানো সম্ভব হয়নি।
নতুন জনসংখ্যা নীতির রূপকল্প হলো, ‘জনসংখ্যার পরিকল্পিত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও জনমিতির লভ্যাংশ অর্জনের মাধ্যমে একটি সুস্থ, সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।’ এতে যেসব বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু, বাল্যবিবাহ কমানো। এ ছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের সুবিধা লাভ, জেন্ডারভিত্তিক সমতা এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। যখন নতুন জনসংখ্যা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তখন দেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জকই বলতে হবে। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১১৯ জন বাস করে, যাদের বড় অংশের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। নানা উদ্যোগ-কর্মসূচি সত্ত্বেও বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না। দেশে ১৫ বছর বা এর বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ কর্মক্ষম নাগরিকের ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশের বেকার থাকা ও শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কম থাকাও উদ্বেগজনক।
মানবাধিকার, ন্যায্যতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, জেন্ডারসমতা, বৈষম্যহীনতা, স্বেচ্ছা সম্মতি ও অবহিত পছন্দ, তথ্যপ্রাপ্তি, গোপনীয়তা, সেবার মান ও অংশীদারত্ব অংশগ্রহণকে ২০২৫ সালের জনসংখ্যা নীতির মূল ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নীতিতে বলা হয়েছে, জনসংখ্যার লভ্যাংশের সুযোগ বাংলাদেশ আর ৩৬ বছর কাজে লাগাতে পারবে। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশ জনসংখ্যার লভ্যাংশের যে সুযোগ পেয়ে আসছে, তা অব্যাহত থাকবে ২০৬১ সাল পর্যন্ত। সে সময়ে জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি। ২০৬২ সাল থেকে জনসংখ্যা কমতে থাকবে। তখন সমাজে প্রবীণ মানুষের হার অনেক বেশি থাকবে। কথা হলো, এসব নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে কি না। অতীতে ভালো ভালো নীতি নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অনেক সময় সরকার বদলের পর নীতি-কর্মসূচিতে ধারাবাহিকতাও থাকে না।
জনসংখ্যা কত বছর পর্যন্ত ধনাত্মক থাকবে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই জনসংখ্যাকে আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী প্রত্যেক নাগরিককে যেমন উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে, তেমনি তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এ বৈষম্য দূর করতে না পারলে জনসংখ্যা নীতি যত যুগোপযোগীই হোক না কেন, কোনো কাজে আসবে না।