বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয় তারমধ্যে ৪৩ শতাংশ মারা যায় পানিতে ডুবে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েলথ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্যব্যবস্থা না থাকায় এর প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।
পৃথিবীর অনেক দেশেই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পানিতে ডুবে অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয় সুইমিংপুলে। আর আমাদের দেশে পানিতে ডুবে অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পুকুরে, জলাশয়ে, ডোবা বা নালায়। পুকুর বা ডোবা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক স্থান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয় যেটি বাড়ির সীমানা বা ঘরের ২০ মিটারের মধ্যে। অবশিষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে ডোবা, নালা, লেক, খাল আর নদীতে। বর্ষা মৌসুমে বিল ঝিলের পানিতে ডুবেও অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। শহরাঞ্চলে অনেক সময় ঢাকনাবিহীন পানির ড্রামে পড়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। শুধু শিশুর মৃত্যু নয় সাঁতার না জানা অনেক বয়স্ক মানুষও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা পত্রপত্রিকার পাতায় প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু একটু সচেতন হলে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন কোন অবস্থায় কোন পরিবেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, অধিকাংশ শিশুরই মৃত্যু ঘটে তাদের প্রতি নজর না রাখার কারণে। শিশুমাত্রই কৌতূহলপ্রিয়। পুকুরের ঘাট দেখলে তারা বড়দের দেখাদেখি নিজেরাও নামার চেষ্টা করে। এ সময় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। অনেক সময় পাকা ঘাটে খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। আবার এমন ঘটনাও দেখা গেছে একজনকে বাঁচাতে গিয়ে অন্য শিশুও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনেক সময় গরুর খাবার দেওয়ার মাটির পাত্রে পড়েও অনেক শিশু মারা যায়। এ গেল ছোট শিশুদের কথা। অনেক কিশোর কিশোরী কৌতূহলের বশে পানিতে বা গোসল করতে নামে। অথচ তারা নিজেরাই জানে না তারা সাঁতার জানে না। এ সাঁতার না জানার কারণে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রিভেন্টিং ড্রাওনিং : অ্যান ইমপ্লিমেন্টেশন গাইডে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষজনকে সম্পৃক্ত করে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মা বাবা অভিভাবকদের নিজ নিজ শিশুদের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখা। বিশেষত গ্রামে যারা বসবাস করেন তাদের এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। ছোট শিশুদের কখনও তাদের দৃষ্টির বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না।
এক সময় গ্রামাঞ্চলে শিশুদের কোমড়ে রেশমের সঙ্গে ঘন্টির মতো কিছু একটা বেঁধে দেওয়া হতো। শিশু হাঁটার সময় বা খেলার সময় আওয়াজ হতো। যাতে করে মা বুঝতে পারত শিশুটি ধারে কাছে আছে। আর যখন শব্দ শোনা যেত না তখন মা বা ভাইবোনেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করত। এতে করে শিশুদের অবস্থান জানা শোনা সম্ভব হতো। শিশুদের পানিতে ডোবার সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে। এ সময় গৃহে থাকা অভিভাবকেরা সাধারণত গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকেন। বড় ভাইবোন থাকলে তারা হয় স্কুলে বা অন্যকাজে থাকেন ব্যস্ত। ফলে কাজের চাপে শিশুদের যথাযথ খোঁজখবর রাখা হয়ে ওঠে না।
এ সময় প্রত্যেক মা বাবা অভিভাবককে অবশ্যই নজরদারি বাড়াতে হবে। পুকুর ঘাটে যাতে শিশুরা নামতে না পারে তার জন্য সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। বর্ষাকালে কিংবা বন্যা কবলিত স্থানে শিশু যাতে ঘরের বাইরে যেতে না পারে তার জন্য সামনের এবং পেছনের দরজার মুখে প্রতিরোধক দিতে হবে। মা বাবার সঙ্গে বা অন্য কারও সঙ্গে শিশু বেড়াতে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখতে হবে। গ্রামবাংলায় নানার বাড়িতে বা কোথাও বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও খুব একটা কম নয়।
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আমরা যদি সতর্কতার সঙ্গে আমলে নিই তাহলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারি। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীমাতৃক দেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট বয়সে শিশুদের সাঁতার শেখাতে হবে। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের মতো ভারি বস্তুর ভার কিছুটা হালকা করতে হলে সচেতনতাই হতে পারে অনিবার্য উপাদান।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক