ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অসময়ের বিষাক্ত আম জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

মো. শামীম মিয়া
অসময়ের বিষাক্ত আম জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

বাংলাদেশে আম মৌসুম সাধারণত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এই সময়ের আগে বা পরে বাজারে আম পাওয়া স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আজকাল প্রায় সারা বছরই বাজারে আম চোখে পড়ে, এমনকি জুলাইয়ের শেষ কিংবা আগস্টের শুরুতেও নতুন আমের সরবরাহ দেখা যায়। প্রশ্ন হলো- এই আমগুলো কতটা প্রাকৃতিক? এবং কতটা নিরাপদ? বিশেষজ্ঞদের মতে, গুটি আম বা গোপালভোগ জাতের আগাম আম সাধারণত মে মাসের শেষের দিকে বাজারে আসে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলি প্রভৃতি জাতের আম জুন থেকে জুলাই মাসে পরিপক্ব হয়। তারপর বাজারে আমের স্বাভাবিক সরবরাহ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আম পাওয়া যাচ্ছে প্রায় সারা বছরই যা প্রাকৃতিক নিয়মের পরিপন্থি। এর অন্যতম কারণ হলো রাসায়নিক প্রয়োগের মাধ্যমে কৃত্রিম পাকা আম তৈরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ক্যালসিয়াম কার্বাইড শরীরে প্রবেশ করলে তা অ্যাসিটিলিন গ্যাসে পরিণত হয়, যা স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, লিভার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ইথিফন নামক রাসায়নিক পাকস্থলীর প্রদাহ, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।

দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় অপরিপক্ব আম সংগ্রহ করে রাসায়নিক প্রয়োগে পাকিয়ে বাজারজাত করছে। তারা জানে, ভোক্তাদের চাহিদা থাকবে এবং ক্ষতি প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট হবে না, তাই প্রতিবাদও কম হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বারবার সতর্ক করলেও বাস্তবে নজরদারি এখনও দুর্বল। বিষাক্ত আম শিশুদের জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক। কারণ শিশুদের শরীর দ্রুত রাসায়নিকের প্রভাব গ্রহণ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হরমোনাল সমস্যা, বুদ্ধিবিকাশে প্রতিবন্ধকতা ও ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। অথচ আমরা এই আমই তাদের টিফিনে বা বিকালে ফল হিসেবে দিচ্ছি। তাহলে আমাদের করণীয় কী? প্রথমত, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে কঠোর নিয়মাবলী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে রাসায়নিক প্রয়োগে পাকানো আম বাজারে আসতে না পারে। দৃষ্টান্তমূলক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

দ্বিতীয়ত, ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে- চকচকে ও ঝকঝকে ফল মানেই ভালো ফল নয়। প্রাকৃতিকভাবে পাকানো আমের গন্ধ, রং ও স্বাদ থেকে রাসায়নিক প্রয়োগের পার্থক্য বোঝার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষকদের জন্য বিকল্প সংরক্ষণ ও বিপণন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে যাতে তারা আগেভাগে আম নামিয়ে বিক্রির জন্য রাসায়নিকের আশ্রয় না নেন। সরকারি উদ্যোগে হিমাগার, শীতলীকৃত পরিবহন ও আধুনিক কৃষিবাজার গড়ে তোলা প্রয়োজন। চতুর্থ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘নিরাপদ খাদ্য’ বিষয়ক সাপ্তাহিক ক্লাস, সেমিনার ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। এতে আগামী প্রজন্ম নিজেও সচেতন হবে এবং পরিবার-সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। সবশেষে বলতে হয়, একটি জাতির সুস্থ ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার খাদ্য নিরাপত্তার ওপর। প্রতিদিনের খাদ্যেই যদি বিষ লুকিয়ে থাকে, তাহলে সেই জাতির উন্নয়নও দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে উঠবে। মৌসুমের বাইরে আম খাওয়ার লোভে পড়ে দীর্ঘমেয়াদে রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হলে, দায় শুধু অসাধু ব্যবসায়ী বা উৎপাদকদের নয়- আমাদেরও।

সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত