কথা প্রসঙ্গে আমরা আটষট্টি হাজার গ্রামের কথা বললেও বাংলাদেশে প্রকৃত গ্রামের সংখ্যা আরও বেশি। নদীভাঙনে প্রতি বছর অনেক গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। তাই গতকাল যা দৃশ্যমান ছিল আজ তা নেই হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামের সংখ্যা ৬৮ হাজার ০৩৮। অন্যদিকে গ্রামীণ-যোগাযোগ সমীক্ষার মতে বাংলাদেশের গ্রামের সংখ্যা ৮৭ হাজার ২৩০ (সর্বশেষ হালনাগাদ ৫ জুলাই ২০২৩)।
যাইহোক- এই ৬৮ হাজার কিংবা ৮৭ হাজার গ্রামে কখন কী ঘটনা ঘটছে, তা সাধারণ মানুষ খুব কমই জানতে পারে। এই প্রসঙ্গে দুটো গানের কলি উদ্ধৃত করছি, ‘প্রতিদিন কত খবর আসে/কাগজের পাতা ভরে/ জীবনপাতার অনেক খবর/ রয়ে যায় অগোচরে।’ সোনালি দিনের গান। এখনও অনেকের মুখে মুখে ফেরে। এই গানের মতোই বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই ছোট দেশটিতে প্রতিদিন কত যে হৃদয় ভাঙার, দুঃখ-বেদনার খবর ঘটে যাচ্ছে তা আমরা জানতে পারি না। বেশিরভাগ খবরই চাপা পড়ে যায় গ্রামের প্রভাবশালীদের তাণ্ডবে কিংবা অপরাধী যদি ক্ষমতাবান বা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পেয়ে থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই! তার কাছে ধরাকে সরা জ্ঞান করা কোনো ব্যাপারই না। এভাবে দেশে কত নির্যাতিত মানুষ মাটি কামড়ে বুকে পাথর চেপে দিনাতিপাত করছে তা কোনো হিসবা নেই। যৌতুকের দাবিতে গৃহবধূকে হত্যা, যৌতুক চাওয়ায় কনের আত্মহত্যা, যৌতুকের দাবিতে গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ, যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীর গায়ে আগুন দেওয়া এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে আমাদের দেশে।
পিটিয়ে হত্যা, গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা, আত্মহননের প্ররোচনা প্রতিটি ঘটনাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে। তাহলে কী আমরা সভ্যযুগে বাস করে আবার মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে আহ্বান জানাচ্ছি। আসলে প্রতিটি ঘটনাই অত্যন্ত লোমহর্ষক ও বেদনাদায়ক। স্বামীর ঘরে গিয়ে কিংবা যাওয়ার আগেই লাশ হওয়ার জন্য কি মা-বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটি মেয়েকে উপযুক্ত করে তোলেন? যদি সত্যের খাতিরে কিছু দিতে হয় তা দেওয়া উচিত কনের বাপকে। কারণ কনের মা-বাবা ২০/২২ বছর ধরে একটি মেয়েকে লালনপালন করেন। শিক্ষাদীক্ষায় উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। মেয়ের ভরনপোষণ আর লেখাপড়ায় তাদের কত টাকা যে খরচ হয় তার কোনো হিসেব নেই। তাই মেয়ের বিয়েতে কনে পক্ষ যদি মেয়েকে গড়ে তোলার যাবতীয় খরচ দাবি করেন তা কি কোনো বরপক্ষ দেবেন? নিশ্চয় দেবেন না! কিন্তু দেওয়া উচিত। অন্যদিকে একজন মেয়ে তার পরমপ্রিয় বাপ-মাকে ছেড়ে অন্যের ঘরে যাচ্ছে।
সেখানে বউ হয়ে যাওয়া মানে রাজরানী হওয়া নয়। কিন্তু প্রত্যেক মা-বাবার কাছে তাদের মেয়েটি রাজকন্যা। আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় বেশিরভাগ মেয়েরা শ্বশুড় বাড়িতে কারো না কারো দ্বারা নিগৃহীত হয়, নির্যাতিত হয়, অবহেলার শিকার হয়। সে খবর কতজন রাখেন। কোনো কোনো পরিবারে স্বামীও জানতে পারেন না তার স্ত্রীর নানা বঞ্চনার কথা।
যৌতুক সামাজিক অবক্ষয়ের আরেক নাম। সমাজে বিদ্যমান এই প্রথাটি ক্যান্সারের মতো মারাত্মক ব্যাধির রূপ নিচ্ছে দিনদিন। ক্যান্সার যেমন শত ওষুধেও সারে না, তেমনি যৌতুকের লোভ বা রোগে যাকে একবার পেয়ে বসে তা থেকে সে কখনও পিছু হটে না। নারী নির্যাতনের যতগুলো ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তারমধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ যৌতুকঘটিত। যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে। শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো যখন চরম আকার ধারণ করে তখনই দু’চারটা প্রকাশিত হয়। মানসিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো থেকে যায় সবার আড়ালে। এমন অনেক নারী আছে চরম মানসিক নির্যাতন সয়েও স্বামী বা বাপের বাড়ির সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয় করে যায়।
একটি গল্পের সংলাপ ছিল এরকম, ছেলে মা-কে বলছে : মা! বাবাতো তোমাকে প্রতিদিন পিটায়, তবু তুমি এখানে পড়ে আছ কেন?
উত্তরে মা আওড়াল শুধু একটি শব্দ, ‘মায়া’। হ্যাঁ। সন্তানের মায়ায় নারীরা শত প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে সংসার নামক সমরাঙ্গনে মৃত্যু অবধি লড়ে যায়। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই স্ত্রীরা স্বামীদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। কখনও মারাত্মক আহত হচ্ছে। কখনও কখনও মারাও যাচ্ছে। নববিবাহিত, বিবাহের সময় যৌতুকের দাবিতো আছেই, এমনকি একাধিক সন্তানের মায়ের কাছেও যৌতুক দাবি করা হচ্ছে।
এ অবসহায়ও অনেক নারীকে সংসার হারাতে হয়। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনে হত্যাকাণ্ডের শিকার নারীর বিরাট অংশই যৌতূকের বলি। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন যৌতুক প্রথা সমর্থন করে না। আইনে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই অপরাধ। আইনে বিয়ের শর্ত হিসেবে বর বা কনে যে কোনো পক্ষের দাবি-দাওয়াকে যৌতুক বলে। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন অনুসারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি কোনো পক্ষ অপর পক্ষকে বিয়ের আগে-পরে বা কথাবার্তা চলাকালীন যে কোনো সময় যে কোনো সম্পদ বা মূল্যবান জামানত হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয় সেটাই যৌতুক বলে বিবেচ্য হবে। তবে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের উপহার যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে যে, এই উপহার অবশ্যই বিয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, এমন কেউ প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ বিয়ের শর্ত হিসেবে ৫০০ টাকার সমমূল্যের কোনো কিছুও দেওয়া যাবে না, দিলে তা আইন অনুসারে যৌতুক হবে এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৮৮ সংখ্যক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’ কনেপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে তার পরিবার থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করা নিঃসন্দেহে জুলুম। ইসলাম শুধু যৌতুক প্রথার বিরোধীই নয়, বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে সব ধরনের অপচয়েরও বিপক্ষে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সেই বিয়েই সর্বাধিক বরকতময়, যে বিয়েতে ব্যয় খুব সামান্যই হয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৪৫২৯)। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুসারে বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বা বিবাহের পণ হিসেবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, যে কোনো সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদকে যৌতুক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ২(খ) ধারায় বলা হয়েছে- যৌতুক বলতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) মোতাবেক প্রদত্ত দেনমোহর বা মোহরানা বুঝাবে না। যারা যৌতুক দাবি করে কিংবা যৌতুক দেয় তারা যে যৌতুকবিরোধী আইন সম্পর্কে অবহিত নয়, তা ঠিক নয়। তবু জেনে শুনে বিষপান করার মতো কাজটি করে শুধু মেয়ের মুখের একটু হাসির জন্য। যখন হাসির বদলে কান্না ভর করে, তখনই নেমে আসে দু’চোখে অমানিশা। বাংলাদেশের আইনে যৌতুক দেওয়া-নেওয়া ও দাবি করা গুরুতর অপরাধ। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ বলা হয়েছে যৌতুক দাবি, প্রদান ও গ্রহণ করার দণ্ড হচ্ছে অনধিক পাঁচ (৫) বছর; কিন্তু অন্যূন এক (১) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। যে ব্যক্তি যৌতুক দেওয়া বা গ্রহণ করার ব্যাপারে সহায়তা করবেন, তিনিও একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আবার, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ (সংশোধিত)-এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে ‘যদি যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু ঘটানো হয়, তাহলে তার জন্য সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে তার জন্য শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একই ধারায় বলা হয়েছে, যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম হলে দোষী ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১২ বছর; কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। এই আপ্তবাক্যের মতো যৌতুকের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন থাকার পরও মানুষের যৌতুক লিপ্সা কমছে না। বরং তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। তার একটিমাত্র কারণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। আইন যদি প্রভাবমুক্ত হতো, নিজস্ব গতিতে চলত, তাহলে এমনটি হতো না। তাই যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে সচেতন মানুষকে। যৌতুক যে মানববিধ্বসী মারণাস্ত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় তা বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক