ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পরাজয়ের ভীতিই কি পিআর প্রীতি

জুবায়ের বাবু
পরাজয়ের ভীতিই কি পিআর প্রীতি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো হঠাৎ করে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনব্যবস্থায় (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) যাওয়ার জোড়ালো দাবি। সারা দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যখন নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে, সরকার এবং অনেক রাজনৈতিক দলগুলোর চলছে প্রস্তুতি, ঠিক তখনই কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের মতাদর্শী বিশ্লেষকের মধ্যে পিআরভিত্তিক নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি প্রীতি চোখে পড়ার মতো। প্রশ্ন উঠছে- এই প্রীতির পেছনে কি আছে? গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা, না কি এটি মূলত পরাজয়ের ভীতিজনিত কৌশলগত অবস্থান?

২০০৭-৮ সালের ফখরুদ্দীন সরকারকে বলা হতো ‘সেনা সমর্থিত সরকার’, বাস্তবেও তাই ছিল। আর বর্তমান ইউনূস সরকারকে বলা হচ্ছে ‘জামায়াত-এনসিপি সম্মর্থিত সরকার’, যাদের আদেশ ব্যতীত সরকারের পাতাও নড়ে না। এই সরকার গোয়ালে আছে কিন্তু কিতাবে নেই। প্রথম আলোর এক গোলটেবিল বৈঠকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে বলে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সরকারের শিরা-উপশিরায় ঢুকে পড়েছে তাদের মতাদর্শীরা। ফলে সরকার হয়ে পড়েছে দিকভ্রান্ত।

১৫ বছরের বহুমাত্রিক আন্দোলন মূলত একদফায় নেমে আসে শুধু একটি কারণে, আর তা হলো একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যর্থতায়। সুতরাং একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নির্বাচন আয়োজনই ছিল, এই সরকারের প্রথম সংস্কার। অথচ একটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গত ১ বছরেও নিতে পারেনি। যেখানে নির্বাচন হলো একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা সময়ের ‘অ্যাকশন পয়েন্ট’, আর সংস্কার হলো সময়ক্রমে প্রকাশিত একাধিক ঘটনা বা ঘটনার ধারাবাহিকতা, যা প্রায়ই কোনো না কোনোভাবে পরস্পর সম্পর্কিত বা সংযুক্ত। কিন্তু সংস্কারের শাক দিয়ে নির্বাচনের মাছ ঢাকতে ব্যস্ত সরকার। যেখানে তারা জানে, নির্বাচন ছাড়া প্রকৃত সংস্কার সম্ভব নয়, আবার নির্বাচন না দিয়েও সংস্কারের সুফল নিশ্চিত নয়। তাই এই নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি নেওয়া ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বিগত সকল নির্বাচনের ফলাফলে জামাত হতাশাগ্রস্ত, তাই নির্বাচনের কথায় তারা ‘ভোটাতঙ্ক’ রোগে ভুগে। অনেকটা সেই আওয়ামী লীগের সরকারের মতো। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হলেও ২২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮টি আসন পায়।

মোট ভোট পেয়েছিল ১২.১৩%, সেই হিসাবে পিআর পদ্ধতিতে ন্যূনতম ৪৮টি আসন পেতে পারত। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচন করে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয় এবং মাত্র ৩টি আসনে জয়লাভ করে, মোট ভোট পেয়েছিল ৮.৬২%, সেই হিসাবে ২৫টি আসন পেতে পারত। ২০০১ সালকে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে যায় এবং বিএনপি ৩০টি আসন ছাড় দিলেও মাত্র ১৭টি আসনে জয়লাভ করে। মোট ভোট পায় মাত্র ৪.২৮% শতাংশ। সেই হিসাবে জোট হয়ে নির্বাচন করায় জামায়াত পিআর পদ্ধতির চেয়ে বেশি আসন লাভ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনটি শ্রেষ্ট নির্বাচনে জামায়াতের ভোট এবং আসন, ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। অর্থাৎ ১৯৯১ থেকে ২০০১, ১০ বছরে ভোটের স্যংখা কমে ৭.৮৫% শতাংশ কমে যায়।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হয়ে মোট ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ২টি আসনে জয় লাভ করে, অর্থাৎ ৩৭টি আসনেই পরাজয় ঘটে দলটির। প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ৪.৬ শতাংশ। সেই হিসাবে কমপক্ষে ১৩টি আসন দাবি করতে পারত। কিন্তু ২টি আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় এই দলটিকে। সুতরাং এমন একটি ব্যবস্থা চান যেখানে পরাজয়ের গ্লানি থাকবে না, বাড়বে আসন সংখ্যা। তাই বর্তমান এফপিটিপি ব্যবস্থায় অনীহা এই দলটির।

অন্যদিকে গত এক বছরে কয়েকটি জরিপের ফলাফল দেখে এখন ‘ভোটাতঙ্ক’ রোগে আক্রান্ত এনসিপি নামের নব্যপ্রসূত দলটিও। প্রতিটি জরিপেই পিছিয়ে আছে। যেহেতু তাদের ভোটারের সংখ্যা নিয়ে অতীতের কোনো তথ্য নেই, তাই তারা পুরোপুরিনির্ভর ছিল তরুণ ভোটারদের উপর। মূলত সেই সব ভোটার, যারা গত ১৫ বছর কোনো ভোট দিতে পারেনি। কিন্তু সর্বশেষ সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর জরিপেও তরুণ ভোটারদের প্রথম পছন্দ বিএনপিকে দেখে দলটি হতাশ হয়ে পড়ে। একদিকে দলের প্রতীক না পাওয়ার বেদনা, নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা, অন্যদিকে সকল জরিপে পরিষ্কার পরাজয়ের ইঙ্গিত, সবমিলিয়ে দলটি এখন ‘ভোটাতঙ্ক’-এ ভুগছে।

ফলে নির্বাচন ছাড়াই যদি ক্ষমতার স্বাধ পাওয়া যায়, ‘তবে তাই হোক’ নীতিতে আছে এই দুটি দল। অথচ গত নভেম্বরে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে এক জরিপে দেশের ৬১.১ শতাংশ মানুষ দ্রুত নির্বাচন চায়। দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এর সংখ্যা এখন হয়তো আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৩ জুন, তারেক রহমান এবং ড. ইউনূসের ঐতিহাসিক বৈঠকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের বিষয়ে একমত হওয়ায় অনেকে ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দেওয়ার মতো অস্বস্তিতে আছে। শুরু হয় নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির পরিকল্পনা। তাতে যোগ দেয় ফ্যাসিস্টদের দোসররা। গোপালগঞ্জের ঘটনার পর পর এনসিপির নেতারা তো রীতিমতো প্রকাশ্যেই বলেন, ‘এই অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’

একই সুরে সুর মিলিয়ে জামায়াতের নেতার একই কথা বলছেন। শুধুমাত্র মব সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, ঔদ্ধত্বপূর্ণ কথাবার্তায় কি আর নির্বাচন পেছানো যাবে? তাই এমন একটি সংকট তৈরি করতে হবে, যেন সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। আর সেই সংকটের নাম পিআর বা প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় একটি দলের জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বরাদ্দ পাবে। অথচ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) ব্যবস্থা চালু রয়েছে, যেখানে প্রতিটি আসনে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হন। দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে অভিযোগ থাকলেও, এই নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কোনো অভিযোগও নেই। পৃথিবীর গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যই বলেন কিংবা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতই বলেন, তারাও এই একই পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করে সফলভাবে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া বাংলাদেশে পিআর ব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে সংবিধান সংশোধনসহ নানা আইনি ও সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক ও ব্রডকাস্টার (লন্ডন)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত