প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
নদী আমাদের সাহসের প্রতীক, দৃঢ়তার প্রতীক। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার দুর্মর কবিতায় বাংলাদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী, অবাক তাকিয়ে রয়’। এ কবিতার প্রথম লাইন শুরু হয়েছিল এভাবে- ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ,/কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে।’ বাংলাদেশের নদীগুলো শুধু ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নয়; বরং এ দেশের কৃষি, পরিবহন, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। নদী রক্ষা করা তাই শুধু পরিবেশগত বা সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, উদ্যোগ ও মতৈক্যও জরুরি।
সম্প্রতি দেশের নদী ও জলাধার-সংক্রান্ত কয়েকটি সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবেশবাদীদের তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে- চলনবিলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ। চলনবিল শুধু দেশের বৃহত্তম বিলই নয়; এটি অসংখ্য প্রজাতির জীবের আবাসস্থল এবং অনন্য জলাধার ব্যবস্থার অংশ। প্রস্তাবিত নির্মাণস্থল বুড়িপোতাজিয়া প্রতি বছর কয়েক মাস পানির নিচে থাকে।
২০১৭ সালের ২৬ জুলাই জাতীয় সংসদে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। কিন্তু বাজেট সংকট ও নানা জটিলতার কারণে প্রকল্প দীর্ঘদিন আটকে ছিল। অবশেষে ২০২৫ সালের আগস্টে একনেক শর্তসাপেক্ষ ছাড়পত্র দিয়ে অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬৭ কোটি টাকা, যার প্রায় অর্ধেকই যাবে বিল ভরাট ও বাঁধ নির্মাণে। ১০০ একর জমি ৯-১৪ মিটার উঁচু করতে প্রয়োজন হবে প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার বালু। অনুমোদনের আগে এবং পরে শিক্ষার্থী, স্থানীয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা আন্দোলনে নামেন। আন্দোলন, প্রতিবাদ ও সমালোচনার চাপের মধ্যেই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়।
চলনবিলের পর এবার হাওরের বুকেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সুনামগঞ্জের ‘দেখার হাওর’ এলাকায় প্রস্তাবিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে এবং এ জায়গাটি বছরের প্রায় সাত মাস পানির নিচে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০২০ সালে পাস হলেও নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত হয়নি। পরে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের বাড়ির কাছাকাছি জায়গা ঠিক করা হলে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
বিলে বা হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস হলে জীববৈচিত্র্য হারায়, কৃষিজমি ও মাছের উৎস নষ্ট হয়, জলাবদ্ধতা ও বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। শুধু মূল ভবন নয়, ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসন, বাজার, সড়ক, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস—সব মিলিয়ে একটি নগরকেন্দ্র গড়ে ওঠে, যা দূষণ ও বর্জ্যরে চাপ বৃদ্ধি করে।
জমি ভরাট, ফাউন্ডেশন ও ড্রেনেজব্যবস্থা নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় হয় এবং ভবিষ্যতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের নিশ্চয়তাও প্রয়োজন। অথচ অনাবাদি বা উঁচু জমিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে খরচও কম হতো, পরিবেশও রক্ষা পেত। তাই বিল বা হাওরের বুক চিরে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ মানে একদিকে পরিবেশ ধ্বংস, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় অর্থ অপচয়।
এরপর সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা। এ মহাপরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও ও নামমাত্র কিছু প্রকাশিত সূত্র থেকে জানা যায়, এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাগলা নদীখ্যাত তিস্তাকে পুনরায় খনন ও উন্নত করে কোটি মানুষের জীবনমান উন্নত করা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিস্তা নদীর দুই তীরের পাশে চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে স্যাটেলাইট শহর তৈরি করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত চীনা কোম্পানি পাওয়ার চায়না থেকে ঋণ এবং কারিগরি সহায়তা নেওয়া হবে।
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো- নদীর দুই তীর বরাবর ১১৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা এবং নদীর প্রস্থ সর্বাধিক এক কিলোমিটারে সীমিত করে নদীর প্রকৃতিকে কৃত্রিমভাবে সর্পিল করা। নদীর বর্তমান গড় প্রস্থ প্রায় তিন কিলোমিটার।
কিন্তু প্রকল্পের বাস্তব উপযোগিতা ও নদীর প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এ মহাপরিকল্পনায় তিস্তা নদীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ করা হবে। ফলে তা আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। উজান থেকে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহকে পর্যাপ্তভাবে নিশ্চিত করতে পারবে না, বরং উল্টো আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনায় ভারতের অন্যায্য নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেবে। ঠিকাদারসহ কিছু সুবিধাবাদী লোকের উদরপূর্তি হবে ঠিকই কিন্তু প্রকৃত ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ কমবে না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদী বিশেষজ্ঞ এবং ভূতত্ত্ববিদসহ পরিবেশবাদীরা শুরু থেকেই এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। তারা বিভিন্ন সভা, সেমিনার এবং সংবাদমাধ্যমে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও বিকল্প পরিকল্পনা তুলে ধরে এ প্রকল্প কতটা অনুপযোগী, তা বারবার প্রমাণ করেই চলেছেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা রাজনৈতিক দিক থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাচ্ছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ২০২৬ সালের শুরু থেকে কাজ শুরু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আবার প্রায় আট বছর ধরে তিস্তা প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থাৎ, প্রকল্পের লক্ষ্য যতটা না পরিবেশ বা নদীবান্ধব, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
চলনবিল, সুনামগঞ্জের হাওর এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা- সবকিছুর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যর অভাব স্পষ্ট। নদী রক্ষায় সামাজিক, পরিবেশবাদী ও স্থানীয় সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে, আবার অনেক সময় প্রাণনাশের হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে।
নদী রক্ষায় দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর কাজ করলেও যথেষ্ট সমন্বয়হীনতার অভাব আছে। আবার সব দিকনির্দেশনা আসে রাজনৈতিক দলের মনোনীত মন্ত্রী বা নিয়োজিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে। প্রশাসনকে সক্রিয় ও জবাবদিহিমূলক করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।
অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দখলদারদের কারণে প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো রাজনৈতিক দলই সত্যিকার অর্থে নদীরক্ষা করতে পারেনি।
সর্বশেষ আস্থা বা ভরসার জায়গা ছিল গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার, কারণ এ সরকার কোনো দলীয় সরকার নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নদী ও পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। এমনকি বর্তমান সরকারের নদীরক্ষা ও সংরক্ষণে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো কোনো পদক্ষেপও দৃশ্যমান নয়। বরং পরিবেশ ও নদী ধ্বংসের বাণিজ্য এতটাই কৌশলী, সংগঠিত ও শক্তিশালী যে, পরিবেশ উপদেষ্টার সাদাপাথর কেলেঙ্কারি নিয়ে তার নিরুপায় মন্তব্য থেকেই আমরা এর কার্যকর প্রমাণ কিছুটা হলেও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি।
চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) শেষ রোববার নদী দিবস আবার ২০২৬ সালের শুরুর দিকে জাতীয় নির্বাচনও আসন্ন। আমাদের দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। নদীকে রক্ষা ও যথাযথ সংরক্ষণ করা এমন একটি উদ্যোগ হবে- যেখানে দল পরিবর্তন হলেও নীতি ও প্রকল্প অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। নদীর দখল-দূষণ রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, বন্যা ও নদীভাঙন মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা বা মতৈক্য না থাকলে নদী সংরক্ষণ ব্যর্থ হবে। নদী বাঁচলে, বাঁচবে প্রাণ-প্রকৃতি, বাঁচবে দেশ এবং রাজনৈতিক মতৈক্য নিশ্চিত করলে নদীরক্ষা ও সংরক্ষণ সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।
লেখক : পরিবেশ ও নারী অধিকারকর্মী