প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নামটি উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে যায় এক অনমনীয় প্রতীক- যে প্রতীকের ভেতরে লুকিয়ে আছে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ আর এক অবিনাশী নৈতিকতার অঙ্গীকার। স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া এই বাহিনী কোনো সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয়; এটি এক জাতির সম্মিলিত আত্মপরিচয়ের প্রতিফলন। যে দেশ একাত্তরে আগুনে পুড়ে জন্ম নিয়েছিল, সেই আগুনের ভস্ম থেকে উঠে আসা এই সেনাবাহিনী জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। অথচ আজকাল মাঝে মাঝেই দেখা যায়, কিছু বিচ্ছিন্ন অপরাধ বা ব্যক্তিগত অনিয়মের দায় পুরো সেনাবাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার এক অদ্ভুত প্রবণতা। এই মানসিকতা শুধু অজ্ঞতার নয়, এটি রাষ্ট্রবোধের দুর্বলতারও প্রকাশ।
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে তিনটি স্তম্ভের ওপর- বিচার, প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা। এদের মধ্যে সেনাবাহিনী এমন এক শক্তি, যা দৃশ্যত শৃঙ্খলার প্রতীক হলেও প্রকৃত অর্থে এটি রাষ্ট্রের ‘নৈতিক মেরুদণ্ড’। যখন প্রশাসনিক নৈরাজ্য, রাজনৈতিক দুর্নীতি বা সামাজিক অবক্ষয় নাগরিক আস্থাকে ভেঙে দেয়, তখন মানুষ শেষ আশ্রয় খোঁজে সেনাবাহিনীর দিকে। কারণ তাদের মনে গেঁথে আছে এক বিশ্বাস- এই বাহিনী এখনও অক্ষত, এখনও তারা সততার শেষ দুর্গ।
কিন্তু এই বিশ্বাসও অনন্তকাল টিকে থাকে না যদি সমাজ তাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সন্দেহ পোষণ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা- যেমন গুম, খুন, বা বিশেষ অভিযানে অপব্যবহারের অভিযোগ- গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারিত হয় যেন পুরো সেনাবাহিনীই কোনো অন্ধকার শক্তি। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। অপরাধ করে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান নয়। একজন অফিসার বা সৈনিকের অনৈতিক আচরণ পুরো বাহিনীর প্রতীক হতে পারে না। যেমন কোনো শিক্ষক অপরাধ করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা যায় না, কিংবা কোনো চিকিৎসকের অনিয়মে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থাকে কলুষিত বলা যায় না।
আমাদের সমাজে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা ক্রমেই জেঁকে বসছে- ‘গুজবের ওপর বিশ্বাস’। কেউ একজন কোনো খবর শুনল, একটু ঘেঁটে না দেখেই সেটি প্রচার করল, আর মুহূর্তের মধ্যে সেটি রূপ নিল ‘সত্যে’। সেনাবাহিনীর মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠান যখন এই গুজবের লক্ষ্যবস্তু হয়, তখন বিষয়টি শুধু একটি বাহিনীর ক্ষতি নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। কারণ জনগণের আস্থা হারানো মানে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা স্তম্ভ ভেঙে পড়া।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধুমাত্র অস্ত্রধারী বাহিনী নয়; তারা মানবিকতারও বাহক। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ধস, মহামারি- যখনই দেশ বিপদে পড়েছে, সৈনিকরা ছুটে গেছে মানুষের পাশে। তারা ঘর বানিয়েছে, রাস্তাঘাট মেরামত করেছে, খাদ্য বিতরণ করেছে। এই নিঃস্বার্থ মানবসেবাই তাদের মর্যাদাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনারা আজ বিশ্বের সম্মানিত নাম। আফ্রিকার মরুপ্রান্ত থেকে হাইতির ধ্বংসস্তূপ পর্যন্ত তারা শান্তি, ন্যায় ও মানবতার বার্তা বহন করেছে। এই যে বৈশ্বিক স্বীকৃতি- এটি এসেছে তাদের নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব ও মানবিক সংবেদনশীলতার কারণে।
তবে এই সম্মান অর্জনের পথ সহজ ছিল না। ইতিহাসের প্রত্যেকটি যুদ্ধক্ষেত্র, প্রত্যেকটি শান্তিরক্ষা মিশন তাদের রক্তে রঞ্জিত। শতাধিক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী আজও ঘরে ফেরেননি; তারা পতাকা বুকে জড়িয়ে নিঃশেষ হয়েছেন মানবতার সেবায়। এই আত্মত্যাগের বিপরীতে কোনো অপবাদ, কোনো গুজব, কোনো বিভ্রান্তিকর প্রচারণা কখনোই ন্যায্য হতে পারে না।
তবু, বাস্তবতা হলো- প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কিছু মানুষ থাকে, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ক্ষমতার প্রলোভনে আদর্শচ্যুত হয়। সেনাবাহিনীতেও এমন কিছু বিচ্যুতি ঘটতে পারে এবং ঘটলে তার জন্য প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা নয়, বরং সেই ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা- এটাই ন্যায়বিচার। সেনাবাহিনীর নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে, যেখানে কোর্ট মার্শাল, পদবনতি, বহিষ্কার বা কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু নৈতিকতা শুধু শাস্তির ভয় দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় না। এটি গড়ে তুলতে হয় চেতনা, শিক্ষা এবং উদাহরণের মাধ্যমে।
সেনাবাহিনীর প্রতিটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে শেখানো হয়- অস্ত্র তোমাকে শক্তি দেয়, কিন্তু নৈতিকতা তোমাকে সম্মান দেয়। এই বাক্যটি যেন বাহিনীর সাংবিধানিক সূত্রবাক্য। কারণ একটি সেনাবাহিনীর শক্তি তার ট্যাংক, রাইফেল বা বিমান নয়; তার প্রকৃত শক্তি নিহিত থাকে তার নৈতিক চরিত্রে। একবার সেই চরিত্র ক্ষয়ে গেলে বাহিনীর অস্তিত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পাকিস্তান, মিয়ানমার কিংবা আফ্রিকার বহু দেশের অভিজ্ঞতা তাই বলে- রাজনীতিতে জড়িত সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত নিজের সম্মানও হারায়, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাও নষ্ট করে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই ভুল পথে হাঁটেনি। তারা বুঝেছে, রাজনীতি হলো পরিবর্তনের, কিন্তু সেনাবাহিনী হলো স্থিতির প্রতীক। রাজনীতি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু দেশপ্রেম স্থায়ী। তাই তারা নিজেকে রাজনীতির থেকে দূরে রেখে জনগণের সেবায় নিবেদিত থেকেছে। অবসরপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তা সমাজে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন- এটি তাদের নাগরিক অধিকার। কিন্তু এদের বক্তব্য বা আচরণকে কখনোই পুরো বাহিনীর অফিসিয়াল অবস্থানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষায় একটি স্পষ্ট যোগাযোগনীতি প্রয়োজন- যেখানে ব্যক্তিগত মত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানের সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকবে।
আজকের বিশ্ব ‘তথ্যযুদ্ধের যুগ’। একটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে এখন আর কামান বা মিসাইল লাগে না; লাগে শুধু একটি মিথ্যা প্রচারণা। একটি ভিডিও ক্লিপ, একটি বিকৃত ছবি বা একটি মনগড়া প্রতিবেদন- মুহূর্তেই কোটি মানুষের মনে সন্দেহের বীজ বপন করতে পারে। তাই সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষায় এখন প্রয়োজন তথ্য-নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং ডিজিটাল সচেতনতা। কারণ গুজবের প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সত্য। একটি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন তার স্বাধীনতা, আর সেই স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হচ্ছে সেনাবাহিনী। এই বাহিনী যদি দুর্বল হয়, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে। তাই যখন কেউ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, তখন সে কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, পুরো রাষ্ট্রের ভিত্তিকে আঘাত করে।
রাফায়েল আহমেদ শামীম
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা