প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপ এবং জাতিপুঞ্জের (League of Nations) চরম ব্যর্থতার ছাই থেকে জন্ম নিয়েছিল জাতিসংঘ। ১৯৪৫ সালে যখন এর সনদ স্বাক্ষরিত হয়, তখন মানবতা এক নতুন স্বপ্ন দেখেছিল এমন এক বিশ্বের স্বপ্ন, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে রক্ষা করা হবে, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা ও মূল্যের ওপর বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং যেখানে সামাজিক প্রগতি ও বৃহত্তর স্বাধীনতার মধ্যে জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
জাতিসংঘের এই আদর্শগুলো ছিল মহৎ, প্রায় ইউটোপিয়ান। কিন্তু আট দশক পার হওয়ার পর, একুশ শতকের এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- সেই আদর্শ বাস্তবায়নে জাতিসংঘ আজ কতটা কার্যকর? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া অসম্ভব। জাতিসংঘের কার্যকারিতাকে একটি সাদা-কালো চশমায় দেখা যায় না; এটি একটি ধূসর ক্যানভাস, যেখানে উজ্জ্বল সাফল্যের পাশাপাশি গভীর ব্যর্থতার ছাপও স্পষ্ট।
আদর্শ ১ : আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা : জাতিসংঘের জন্মের মূল উদ্দেশই ছিল যুদ্ধ বন্ধ করা। এই ক্ষেত্রে এর সাফল্য মিশ্র। একদিকে, সংস্থাটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আটকাতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। স্নায়ুযুদ্ধের চরম উত্তেজনার মুহূর্তেও (যেমন- কিউবান মিসাইল সংকট) এটি আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য শান্তিরক্ষী মিশন (Peace keeping Missions) সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা এনেছে, যদিও তা প্রায়শই সমালোচিত।
কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠ ভয়াবহ। জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এর নিরাপত্তা পরিষদে (Security Council) নিহিত। পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের ‘ভেটো ক্ষমতা’ সংস্থাটির আদর্শকে বারবার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে জিম্মি করেছে। রুয়ান্ডা বা স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যা জাতিসংঘ ঠেকাতে পারেনি। সিরিয়ার এক দশকের গৃহযুদ্ধ, ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন কিংবা হালের ইউক্রেন যুদ্ধ এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ কোনো না কোনো স্থায়ী সদস্যের স্বার্থ এতে জড়িত ছিল। জাতিসংঘ এখানে তার নিজের আদর্শের কাছেই পরাজিত।
আদর্শ ২ : মানবাধিকারের সুরক্ষা : মানবাধিকারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ১৯৪৮ সালের ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’ (UDHR)। এটি আজ বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে স্বীকৃত। এই ঘোষণাপত্র এবং পরবর্তী বিভিন্ন কনভেনশন বিশ্বব্যাপী নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের মানদ- তৈরি করেছে।
কিন্তু এখানেও প্রয়োগের দুর্বলতা প্রকট। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল প্রায়শই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়; অনেক সময় দেখা যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত দেশগুলোই এই কাউন্সিলের সদস্য। যখন বড় শক্তিগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, বা তাদের মিত্র দেশগুলো তা করে, তখন জাতিসংঘকে প্রায়শই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। আদর্শের কথা সনদে লেখা থাকলেও, বাস্তবে তা প্রয়োগের ইচ্ছাশক্তি বা ক্ষমতার অভাব স্পষ্ট।
আদর্শ ৩ : সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন : জাতিসংঘের কার্যকারিতা যদি শুধু নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতা দিয়ে মাপা হয়, তবে তা হবে ঘোর অবিচার। সংস্থাটির আসল শক্তি লুকিয়ে আছে এর বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর মধ্যে, যারা পর্দার আড়ালে থেকে নীরবে বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) গুটিবসন্তকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করেছে। ইউনিসেফ (UNICEF) বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি শিশুর জীবন রক্ষা ও শিক্ষার জন্য কাজ করছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে (এবং এর জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছে)। ইউনেস্কো (UNESCO) আমাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করছে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) এবং পরবর্তী সময়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় একটি বৈশ্বিক রূপরেখা দিয়েছে। এই ‘নরম ক্ষমতা’ (Soft Power) প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ অসামান্যভাবে সফল। এই সংস্থাগুলো ছাড়া পৃথিবী নামক গ্রহটি নিঃসন্দেহে আরও অনেক বেশি বাস অযোগ্য হয়ে উঠত।
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ : জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতারা জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার যুদ্ধ, বৈশ্বিক মহামারি বা আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসবাদের মতো জটিল সমস্যার কথা হয়তো ভাবেননি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় (প্যারিস চুক্তির মতো) বৈশ্বিক ঐকমত্য সৃষ্টির একমাত্র প্ল্যাটফর্ম এই জাতিসংঘই। কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকায় ঘাটতি থাকলেও, একটি বৈশ্বিক সমন্বয়ক সংস্থা ছাড়া পরিস্থিতি আরও কত ভয়াবহ হতে পারতো, তা সহজেই অনুমেয়। তাহলে জাতিসংঘ কি তার আদর্শে কার্যকর? বাস্তবতা হলো, জাতিসংঘ কোনো বিশ্ব সরকার নয়। এটি তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমষ্টি মাত্র- বিশেষত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ইচ্ছার প্রতিফলন। এটি একটি আয়নার মতো, যা আমাদের বিভাজিত, স্বার্থপর অথচ পরস্পর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রতিচ্ছবি ধারণ করে।
যখন আমরা জাতিসংঘের ব্যর্থতার কথা বলি, তখন আমরা আসলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতার কথাই বলি। যখন নিরাপত্তা পরিষদ ভেটোর কারণে অকার্যকর হয়, তখন বিশ্বশান্তির আদর্শের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘ ত্রুটিপূর্ণ, আমলাতান্ত্রিক এবং প্রায়শই হতাশাজনকভাবে ধীর। কিন্তু এর আদর্শগুলো শান্তি, মানবাধিকার, উন্নয়ন মানবতার জন্য আজও ধ্রুবতারার মতো অপরিহার্য। দগ হ্যামারশোল্ডের সেই বিখ্যাত উক্তিটিই হয়তো এর সেরা সারমর্ম : ‘জাতিসংঘ আমাদের স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি, বরং নরক থেকে বাঁচানোর জন্য তৈরি হয়েছে।’
আদর্শের শতভাগ বাস্তবায়ন হয়তো কখনই সম্ভব নয়, কিন্তু সেই আদর্শের পানে ছুটে চলার জন্য জাতিসংঘের কোনো বিকল্প আজও তৈরি হয়নি। এটি ভেঙে পড়লে বিশ্ব ‘মাৎস্যন্যায়’- এর যুগে প্রবেশ করবে, যেখানে শক্তিশালী দুর্বলকে গ্রাস করবে। তাই জাতিসংঘকে অকার্যকর বলে বাতিল করে দেওয়া নয়, বরং এর দুর্বলতাগুলো স্বীকার করে একে আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে তোলাই একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ দিনশেষে, এই বিশ্বসভার সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সবার।
হেনা শিকদার
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, দর্শন বিভাগ