প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫
আমাদের দেশে নারীদের সুরক্ষার জন্য অনেক আইন আছে। কাগজে-কলমে সব ঠিকঠাক দেখায়। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই চোখে পড়ে নারী নির্যাতনের খবর। রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি নিজের ঘরেও নারীরা নিরাপদ নয়। তাহলে প্রশ্ন আসে- আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ কোথায়? আমাদের দেশে নারী নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু শক্তিশালী আইন আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ঘরোয়া হিংসা প্রতিরোধ আইন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, পারিবারিক সহিংসতা রোধে আইন- এসব আইনে নারীদের সুরক্ষার জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। শাস্তির বিধান আছে, ক্ষতিপূরণের কথা বলা আছে। কিন্তু এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
একজন নারী যখন নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় যান, তখনই শুরু হয় তার প্রথম বাধা। অনেক সময় পুলিশ মামলা নিতে চায় না। নানা রকম প্রশ্ন করা হয়, সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ‘আপনি কেন সেখানে গিয়েছিলেন?’ ‘আপনার পোশাক কেমন ছিল?’ এমন সব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ভুক্তভোগীকে আরও মানসিক কষ্ট দেওয়া হয়।
অনেক নারী এই লজ্জা ও হয়রানির ভয়ে মামলাই করতে যান না। যদি কোনোভাবে মামলা হয়েও যায়, তাহলে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। আদালতে মামলা চলে বছরের পর বছর। তারিখের পর তারিখ পড়ে। একজন সাধারণ নারীর জন্য বারবার আদালতে যাওয়া, উকিল রাখা, খরচ চালানো- সব মিলিয়ে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই দীর্ঘসূত্রিতায় অনেকে হাল ছেড়ে দেন। অপরাধী পার পেয়ে যায়। আমাদের সমাজে এখনও একটা ভুল ধারণা আছে যে নির্যাতনের জন্য কোনো না কোনোভাবে নারীই দায়ী। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রতিবেশীরাও ভুক্তভোগীকে নানা কথা শোনায়।
‘মামলা করলে সমাজে মুখ দেখাবে কীভাবে?’, ‘মেয়ের বিয়ে হবে না’ - এমন ভয় দেখানো হয়। এই সামাজিক চাপের কাছে হার মেনে অনেক নারী ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। আদালতে মামলা জেতার জন্য দরকার শক্ত প্রমাণ। কিন্তু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রমাণ সংগ্রহ করা খুব কঠিন। সাক্ষী পাওয়া যায় না, মেডিকেল রিপোর্ট সঠিক সময়ে করা হয় না, ঘটনাস্থল সংরক্ষণ করা হয় না। এসব কারণে অনেক সময় দোষী ব্যক্তিও বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। আমাদের দেশে এখনও টাকা ও ক্ষমতার জোর খুব বেশি। যদি অপরাধী প্রভাবশালী হয়, তাহলে সে নানাভাবে মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। পুলিশ, উকিল, এমনকি কখনো কখনো বিচারকদেরও প্রভাবিত করার চেষ্টা চলে।
সাধারণ একজন নারীর পক্ষে এই শক্তিশালী অপরাধীর বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার অফিস, কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- সর্বত্র নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন। আইন অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে কতগুলো প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি আছে? আর যেখানে আছে, সেখানেও কি সেগুলো সক্রিয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব কমিটি শুধু কাগজে-কলমে আছে। নারীরা অভিযোগ করতে ভয় পান চাকরি যাওয়ার ভয়ে। বাসে, ট্রেনে প্রতিদিন নারীরা উত্ত্যক্তের শিকার হন। কিন্তু কে শোনে সেসব কথা? ভিড়ের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ধাক্কা, অশ্লীল মন্তব্য, অশালীন স্পর্শ- এসব নিত্যদিনের ঘটনা। রাস্তায় ইভটিজিং তো আছেই। পুলিশ কোথায়? আইন কোথায়? এসব ক্ষেত্রে কার্যত কোনো আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো ঘরোয়া সহিংসতা। স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে নির্যাতিত হয়ে অসংখ্য নারী নীরবে কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন।
কারণ আমাদের সমাজ মনে করে ‘ঘরের কথা ঘরেই থাকা উচিত’। পরিবার ভাঙতে দেওয়া যাবে না এই ভেবে অনেক নারী সারাজীবন অত্যাচার সহ্য করেন। আইন আছে, কিন্তু ঘরের চার দেওয়ালের ভেতরের অপরাধ ধরা পড়ে না। অনেক নারী জানেনই না যে তাদের কী কী অধিকার আছে, কোথায় যেতে হবে, কীভাবে অভিযোগ করতে হবে। আবার অনেকে জানলেও ভয়ে বা লজ্জায় এগিয়ে আসেন না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ও এসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান দেওয়া হয় না। সামাজিক সচেতনতার অভাব আইন প্রয়োগের একটা বড় বাধা।
নারী নির্যাতনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে রায় দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত হলে অপরাধী যেমন শাস্তি পাবে, তেমনি অন্যরাও অপরাধ করতে ভয় পাবে। পুলিশ বাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নারী নির্যাতনের ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, কীভাবে সংবেদনশীলভাবে তদন্ত করতে হয়- এসব শেখাতে হবে।
প্রতিটি থানায় মহিলা পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যাতে নারীরা নিঃশঙ্কোচে অভিযোগ করতে পারেন। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সমাজকে বুঝতে হবে যে নির্যাতনের জন্য ভুক্তভোগী নয়, অপরাধীই দায়ী। নারীদের পোশাক, চলাফেরা, সময় - এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা বন্ধ করতে হবে। মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতা, সামাজিক সংগঠন - সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনে। আইনি সহায়তা সহজলভ্য করতে হবে। গরিব ও অসহায় নারীদের জন্য বিনামূল্যে আইনি সহায়তার ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
সরকারি খরচে উকিল নিয়োগ, মামলার খরচ বহন - এসব নিশ্চিত করতে হবে। যাতে টাকার অভাবে কেউ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সহজে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা, জরুরি হেল্পলাইন - এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী নিরাপত্তা বাড়ানো যায়। এরইমধ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা আরও বিস্তৃত করতে হবে। আইন যতই কঠোর হোক, যদি শাস্তি নিশ্চিত না হয়, তাহলে অপরাধ কমবে না। প্রতিটি অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রভাব-প্রতিপত্তি যেন আইনের চেয়ে বড় না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, সমাজ - সবার দায়িত্ব আছে। নারীরা এই দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা। তারা নিরাপদ না থাকলে দেশ এগোতে পারে না। আইনের কার্যকর প্রয়োগ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটা নিরাপদ সমাজ গড়তে পারি। আমরা এমন একটি নিরাপদ সমাজ চাই যেখানে - আইন শুধু বইয়ে নয়, বাস্তব জীবনেও এর প্রতিফলন থাকবে।
তামান্না ইসলাম
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়