প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশ এখন দ্রুত পরিবর্তনের পথে। একদিকে শিল্প, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জোয়ার; অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনের শিকড়ভিত্তিক বাস্তবতা। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু হলো নগরায়ন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও আধুনিক জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও, একইসঙ্গে সমাজে তৈরি করছে গভীর অসাম্য ও ভারসাম্যহীনতা। প্রশ্ন হলো, যে নগর আমাদের উন্নয়নের প্রতীক, সেই নগর কি সত্যিই সবার জন্য? আর গ্রাম, যে ছিল আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি, তা কি কেবল শ্রমের উৎস হিসেবে থেকে যাচ্ছে?
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর নগরায়ন শুরু হয় ধীর গতিতে। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশের নগর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। আজ, ২০২৫ সালে এসে সেই সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ, প্রতি তিনজন বাংলাদেশির একজন আজ শহরে বাস করছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট এখন জনসংখ্যার চাপে হাঁপিয়ে উঠেছে। ঢাকা একাই দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৩৬% উৎপাদন করছে। কিন্তু একই সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করছে দেশের প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ, যার অর্ধেকই অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত এবং নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বাস করে, যাদের জীবনজীবিকা মূলত কৃষিভিত্তিক। কিন্তু নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন নীতির ফলে গ্রামের অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান এখনও তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ফলে, গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত থামানো যাচ্ছে না। নগর হলো উন্নয়নের ইঞ্জিন। নগর অর্থনীতি জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। শহরে শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা একত্রিত হয়। এতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ে, মানুষ আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশে নগর কেন্দ্রিক শিল্পায়ন, বিশেষ করে গার্মেন্টস, ওষুধ, নির্মাণ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একই সঙ্গে নগরে শিক্ষা ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
নগরের আরেকটি বড় ভূমিকা হলো গ্রামকে চালিত করা। গ্রামের শ্রমিকরা শহরে এসে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, শহরের উৎপাদিত পণ্য গ্রামে যাচ্ছে, ফলে একটি পরোক্ষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই সম্পর্কটি একমুখী, গ্রাম দিচ্ছে শ্রম, শহর নিচ্ছে ফল। এই একমুখী প্রবাহই ভারসাম্য নষ্ট করছে। নগরায়নের মূল চাপ এখন পড়েছে গ্রামীণ সমাজে। কৃষিভিত্তিক জীবিকা আজ আর টেকসই নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, জমির খণ্ডিতকরণ, উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি ও ফসলের কম দাম; সব মিলিয়ে কৃষকের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে, গ্রামীণ যুবকরা শহরে চলে যাচ্ছে কাজের খোঁজে। কেউ গার্মেন্টসে, কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ নির্মাণশ্রমিক হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু এর ফলে গ্রামে শ্রমশক্তির ঘাটতি, পারিবারিক বন্ধনের ভাঙন এবং সামাজিক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। গ্রামের স্কুলগুলোতে ছাত্রসংখ্যা কমছে, কৃষিকাজে অভিজ্ঞতা হারিয়ে যাচ্ছে এবং গ্রামীণ ঐতিহ্য; যেমন পল্লী সংস্কৃতি, উৎসব, পারস্পরিক সহায়তা ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে।
যত মানুষ শহরমুখী হচ্ছে, ততই বাড়ছে নগর ব্যবস্থাপনার চাপ। ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। প্রতিদিন প্রায় ১,৫০০-২,০০০ মানুষ নতুন করে ঢাকায় আসে। কিন্তু নগরের অবকাঠামো, পরিবহন, আবাসন, পানি, বিদ্যুৎ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সবই সীমিত। ফলাফল? যানজট, দূষণ, পানি সংকট, বস্তিবাসের বৃদ্ধি, অপরাধ, এবং মানসিক চাপ। শহরে বসবাস এখন আর আরামদায়ক নয়; বরং এক অনিশ্চিত সংগ্রাম। নগরায়নের এই অনিয়ন্ত্রিত ধারা একদিকে অর্থনীতিকে বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের জীবনমানকে কমাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন নীতি বরাবরই নগরকেন্দ্রিক। বড় বাজেট যায় ঢাকা-চট্টগ্রামের অবকাঠামো প্রকল্পে; কিন্তু গ্রামীণ সড়ক, কৃষি গবেষণা বা স্থানীয় উদ্যোক্তা বিকাশে ব্যয় তুলনামূলক কম। ফলে, শহর আরও ধনী হচ্ছে, আর গ্রাম ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। এই ‘দ্বৈত বাংলাদেশ’ একদিকে ঝলমলে নগর, অন্যদিকে অনিশ্চিত গ্রাম, একটি গভীর সামাজিক বৈষম্য তৈরি করছে। রাজনৈতিকভাবে এটি বিপজ্জনক, কারণ গ্রামীণ জনগণই দেশের ভোটের ভিত্তি। যদি তাদের জীবনমান উন্নত না হয়, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে শহরেও। ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতির ফলে ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু শহরের তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলে এখনো প্রযুক্তি ব্যবহারে বড় ব্যবধান রয়ে গেছে। যেখানে শহরের তরুণরা ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ, ই-কমার্সে যুক্ত, সেখানে গ্রামের তরুণরা এখনও মৌলিক প্রযুক্তি জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। এই ব্যবধান শিক্ষায়, কর্মসংস্থানে ও আয়ে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করছে। নগরায়ন নারীর জীবনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে; শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সিদ্ধান্তগ্রহণে অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু গ্রামীণ নারীরা এখনও সমাজের প্রথাগত ভূমিকার মধ্যে আবদ্ধ। তবে কৃষি, হস্তশিল্প ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গ্রামীণ নারীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। তাদের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন সুযোগ, যা শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন নীতিতে প্রায় উপেক্ষিত।
নগর ও গ্রাম একে অপরের বিকল্প নয়, বরং পরিপূরক। গ্রাম সরবরাহ করে খাদ্য, শ্রম ও কাঁচামাল; শহর সরবরাহ করে পণ্য, প্রযুক্তি ও সেবা। এই দ্বিমুখী প্রবাহই ভারসাম্যের মূল চাবিকাঠি। কিন্তু বাস্তবে শহর-গ্রামের যোগাযোগ এখনও সীমিত ও একমুখী। যদি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শহরের সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত করা যায়। যেমন: গ্রামীণ শিল্পাঞ্চল, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, সড়ক ও রেল সংযোগ; তাহলে ভারসাম্য আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন নয়, অঞ্চলভিত্তিক নগরায়নই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের শহর (যেমন- রংপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, যশোর) কে শক্তিশালী করলে কর্মসংস্থান ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা সেই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। তাতে ঢাকার উপর চাপ কমবে, আর গ্রামীণ অর্থনীতি টিকবে। এছাড়া ‘স্মার্ট ভিলেজ’ বা ‘ডিজিটাল গ্রাম’ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাজার ও প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হবে। নগরায়নের ফলে গ্রাম হারাচ্ছে জমি ও জলাভূমি। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে অসংখ্য কৃষিজমি দখল হয়ে গেছে শিল্পাঞ্চলের জন্য। নদী, খাল, বিল ভরাট হচ্ছে কংক্রিটে।
আরিফুল ইসলাম রাফি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ