ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি নির্মাণে দ্রুত বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি

ওসমান গণি
অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি নির্মাণে দ্রুত বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশে। এদেশের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ লোকের প্রধান পেশাই হলো কৃষিকাজ। কৃষি হলো আমাদের দেশের প্রাণ। কৃষিনির্ভর দেশ বাংলাদেশ। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশটির প্রায় ৮০ ভাগ লোকই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। তা সত্ত্বেও নদীভাঙনের পাশাপাশি নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় এক লাখ হেক্টর কৃষিজমি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের মোট ভূমির অর্ধেকই চলে যাবে শুধু বসতি স্থাপনের জন্য। এতে করে একদিকে জমি না থাকায় কৃষক ফসল উৎপাদন করতে পারবে না, অন্যদিকে টাকা বা ডলার হাতে থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত খাদ্য পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কালের পরিক্রমায় নানাবিধ কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে কৃষিজমি। আমাদের দেশের কৃষিতে অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান। কিন্তু ক্রমাগত কৃষিজমি বিনষ্ট হওয়ার ফলে এর সম্ভাবনা এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একসময় গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলি জমি ও কৃষির দেখা মিললেও বর্তমানে কৃষিজমি ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার ফলে আগের মতো সে দৃশ্য দেখা যায় না। বর্তমানে শহর ও গ্রামে অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি নির্মাণ ও শিল্পকারখানা স্থাপন কৃষিজমি কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। এ ছাড়া শিল্পায়ন, বিভিন্ন কল-কারখানা নির্মাণ, ইটভাটা তৈরি, নদীভাঙন, বন্যা ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ প্রভৃতি কৃষিজমি কমে যাওয়ার পেছনে বিশেষভাবে দায়ী। গ্রামাঞ্চলে কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরি নতুন কিছু নয়। কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরির ফলে আশপাশের জমিসহ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ার ফলে এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কৃষিজমি।

এ ছাড়া বর্তমানে জমিতে পুকুর খনন করার দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। এভাবে আবাদি জমি ক্রমহ্রাসমান। বাংলাদেশে মোট ভূমির সিংহভাগই কৃষিজমি। কিন্তু কৃষি উপযোগী আমাদের দেশে কৃষিজমি রক্ষা করা যাচ্ছে না। গ্রামীণ জনপদের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল কেন্দ্র কৃষিভিত্তিক শিল্প। দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। কিন্তু নগরায়ণের আগ্রাসনে খাদ্যের প্রধান উৎস কৃষিজমি এখন অস্তিত্ব সংকটে। দিন দিন কমছে কৃষিজমি। জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কৃষকের সংখ্যাও যাচ্ছে কমে। এ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারেও কমেছে কৃষকের সংখ্যা। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির মুখে পড়বে। এরই মধ্যে অনেক মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে পেশা বদল করেছেন। জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশে জনসংখ্যা। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০-৩৫ লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সে তুলনায় কৃষিজমি এক শতাংশও বাড়ছে না। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক হারে নগরায়ণ ঘটছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক শতাংশ হারে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যার ফলে আবাদি কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে নগরায়ণ। কৃষিজমিতে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে আশপাশের জমিগুলোতে মাটির উর্বরতা ও ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ।

এত কিছুর পরও কৃষিজমি রক্ষা করে আমাদের দেশে খাদ্যে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জমিতে উৎপাদিত ফসল বিদেশে রপ্তানি করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কৃষিজমি ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলমান থাকায় সে সম্ভাবনায় ভাটা পড়েছে। ক্রমাগত কৃষিজমি হ্রাস ও খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে দেশে একসময় খাদ্যসংকট দেখা দেবে। ফলে আগামীর অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারে অনেকটাই আমদানিনির্ভর। কৃষিজমির পরিমাণ কমতে থাকায় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এখনই কৃষিজমি রক্ষা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ এ ইট-পাথরের দালান ছাড়া কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অস্তিত্ব থাকবে না। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কৃষিজমি রক্ষা ও ফসল উৎপাদনে গতিশীলতা জরুরি। কৃষিজমি রক্ষা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দেশকে সমৃদ্ধ করতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু কৃষিজমির পরিমাণ কমতে থাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গতিশীলতা অনেকটা কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কৃষির ভূমিকা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দাপট ফিরিয়ে আনতে সরকারের নেই বিশেষ কোনো পদক্ষেপ। তাই কৃষিজমি রক্ষায় মানুষকে সচেতন করতে হবে।

কৃষিজমি নষ্ট করে ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা যাবে না। এসব কাজে অনুর্বর উঁচু জমি ব্যবহার করা যেতে পারে। কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কেটে ইট তৈরির মতো ক্ষতিকর কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে ইটের পরিবর্তে সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষিজমির মাটি কেটে কোনো রাস্তাঘাটও বানানো ঠিক হবে না। রাস্তাঘাটের মাটির জন্য নদী খনন করে, সেই মাটি ব্যবহার করতে হবে। এতে একদিকে নদীর নাব্য বাড়বে, অন্যদিকে রক্ষা পাবে মূল্যবান কৃষিজমি। সেই সঙ্গে নদীভাঙন রোধে গ্রহণ করতে হবে সময় মতো সর্বাধুনিক টেকসই প্রযুক্তি।

অন্যথায় দেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। সেই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণ রোধ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক কাজে কৃষিজমির ব্যবহার বন্ধ, জমি খনন করে পুকুর তৈরি, মাটির উর্বরতা শক্তি বজায় রাখতে জমিতে ইটভাটা ও কল-কারখানা নির্মাণ বন্ধ ও পরিবেশ রক্ষায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দাপট ফিরিয়ে আনতে কৃষিজমি সুরক্ষার জন্য সরকারিভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই হতে হবে উদ্যোগী।

কৃষি জমি যে-হারে কমছে সেই হারেই ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে তা পূরণ করতে হবে। আমরা সকলেই সহজ ও সরল হিসাবটি বুঝতে পারি, আর সেটি হলো কৃষি জমি কমে গেলে কৃষি ফসল উৎপাদন ই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তাই কম খাদ্যে বেশি পরিমাণ পুষ্টি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কৃষি বহুমুখীকরণ, ফসল ফলানোর মৌসুম বৃদ্ধি করা, কমদিনে ফলে এমন ফসলের বিভিন্ন জাত সৃষ্টি করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে ফসলহানি থেকে রক্ষা করা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে কৃষিকে রক্ষা করা, পুষ্টিসম্মত খাবার গ্রহণের বিষয়ে নাগরিকদের সচেতন করা ইত্যাদি। তাছাড়া কৃষিজমি রক্ষার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীর জেগে উঠা চরকে দ্রুত কৃষিজমির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অপরদিকে নদীভাঙন রোধ করার জন্য নদীর পাড় বাঁধাই করা একটি বড় উদ্যোগ হতে পারে। এভাবে সচেতনতা সৃষ্টি ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই কৃষিজমি কমতিজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। এভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

তাছাড়া গ্রামীণ পরিবেশ হলো- মানুষের অক্সিজেন কারখানা। আসলে একটি দেশের শ্বাস নেবার ফুসফুস স্বরূপ। অপরিকল্পিত নগরায়নের থাবায় যদি এই ফুসফুসে ক্ষত তৈরি হয় তা হলে স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ সুস্থ জাতি গড়ে তোলাই দূরূহ হয়ে পড়বে। মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মতো সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে কেবল এর চতুষ্পার্শ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করে ফেলার কারণে। এমন আরও অনেক সভ্যতাই মানুষের হটকারিতার শিকার হয়ে ধরণীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইতিহাসের এইসব উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নেবার চেতনা না জাগলে একই পরিণতি আমাদেরও বরণ করতে হবে। সে ধ্বংস আমরা ডেকে আনতে পারি না। বলা হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাসন চাহিদার কারণে কৃষি জমি লোপাট হচ্ছে। আমরা মনে করি আবাসন চাহিদা মিটাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে কৃষিজমির উপর চাপ কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ওসমান গণি

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত